বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৩

আধ্যাত্মিকবিদ্যা ক্রমবিলুপ্তির কারণাদি (আত্মদর্শন, আত্মতত্ত্ব, আধ্যাত্মিকবিদ্যা, দিব্যজ্ঞান, দেহতত্ত্ব এবং বলন দর্শন নোট)

আধ্যাত্মিকবিদ্যা বা রূপকসাহিত্য পৃথিবীর বুক হতে বিলুপ্ত হওয়ার অধিক গুরুত্বপূর্ণ অনেকগুলো কারণ রয়েছে। একদিকে বাংলাভাষায় আজ পর্যন্ত কোন রূপকসাহিত্য নির্মিত হয়নি বিধায় সাম্প্রদায়িক ও পারম্পরিক কোন মতবাদও বাংলাভাষায় গড়ে উঠেনি। আধ্যাত্মিকবিদ্যা বিলুপ্ত হওয়ার কারণাদি নিচে সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরা হলো।

১. আধ্যাত্মিকশব্দাবলী অভিধানে সংকলন না করণ
পাঠক বা গবেষক মাত্রই জানেন যে, বর্তমান পৃথিবীতে প্রায় উনিশ (১৯)টি সাম্প্রদায়িকমতবাদ বিশ্বজনীনতা অর্জন করেছে। প্রায় সারাবিশ্বব্যাপী এ উনিশ (১৯) টি সাম্প্রদায়িকমতবাদের অনুসারিদের ন্যূনাধিক বসবাস করতে দেখা যায়। উক্ত মতবাদাদির শাখাপ্রশাখাসহ প্রায় কয়েক সহস্রের অধিক মতবাদাবলম্বী লোকের বসবাসের সন্ধান বর্তমান পৃথিবীতে পাওয়া যায়। বর্তমান বাংলাদেশেই প্রায় পঞ্চাশ (৫০) টিরও অধিক জাতিসত্তার মানুষ বাস করে।

প্রায় বারোশত (১,২০০) বছর পূর্বে আমাদের বাংলাভাষার সৃষ্টি। ব্যবহারের দিক হতে আমাদের বাংলাভাষা বর্তমান পৃথিবীতে ষষ্ঠস্থানে স্বভূমিকায় প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু বাংলাভাষায় কোন আধ্যাত্মিকগ্রন্থাদি না থাকায় প্রাণভরা আবেগ ও আকুতি থাকা সত্ত্বেও বাংলাভাষায় একটি শাস্ত্রীয়সংস্কার কিম্বা আধ্যাত্মিকনীতিমালা নির্মাণ করা বাঙালী গবেষক, চিন্তাবিদ ও সাম্প্রদায়িকমতবাদী পণ্ডিতগণের পক্ষে আজও সম্ভব হয়নি। কিন্তু একটি স্বাধীন ও স্বকীয় জাতির নিকট সাম্প্রদায়িকশাস্ত্র, শাস্ত্রীয়সংস্কার, মতবাদাবতারের প্রতি গভীর ভালোবাসা, সাম্প্রদায়িক গল্পকাহিনি ও সাম্প্রদায়িক উপন্যাসাদির প্রতি সম্মান কিম্বা প্রয়োজন মানুষের মৌলিক প্রয়োজনাদির চেয়ে কোন অংশে স্বল্প নয়।

গত ১৩০১ খ্রিস্টাব্দে ছুলত্বানি শাসকগণের দ্বারা সমগ্র বঙ্গদেশ স্বাধীন হয়। মূলত তখন হতেই বাঙালী গবেষক, চিন্তাবিদ, লেখক, কবি ও সাহিত্যিকগণের মধ্যে সাম্প্রদায়িকশাস্ত্র, শাস্ত্রীয়সংস্কার, মতবাদাবতারের প্রতি গভীর ভালোবাসা, সাম্প্রদায়িক গল্পকাহিনি ও সাম্প্রদায়িক উপন্যাসাদির প্রতি স্বাধীন বাঙালিদের ভালোবাসা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। কিন্তু বাংলাভাষায় সাম্প্রদায়িকশাস্ত্র, সাম্প্রদায়িক সংস্কার, সাম্প্রদায়িক গল্পকাহিনি ও সাম্প্রদায়িক উপন্যাসাদি না থাকায় অন্যান্য ভাষা হতে সাম্প্রদায়িক ও আধ্যাত্মিকগ্রন্থাদি বাংলাভাষায় অনুবাদ করার চরম ও পরম অভাব অনুভব করেন বাঙালী গবেষকগণ। কিন্তু মতবাদান্ধ, গোঁড়া ও চরমপন্থিদের কবলে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে অন্যান্য ভাষায় সাম্প্রদায়িকশাস্ত্রাদি কিম্বা আধ্যাত্মিকগ্রন্থাদি বাংলাভাষায় অনুবাদ করার তেমন সাহস করতেন না বাঙালী গবেষকগণ।

গত ১৪১৪ খ্রিস্টাব্দে রাজসভায় বাংলাভাষার ব্যবহার ও বাংলাভাষায় সাহিত্য রচনার স্বকীয়তালাভ করার পর হতে বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক মতবাদান্ধ চরমপন্থিদের গোঁড়ামিও ক্রমেক্রমে হ্রাস পেতে থাকে। ফলে কবি কিত্তিবাস সর্ব প্রথম সংস্কৃতভাষায় রচিত আদি “বাল্মীকি রামায়ণ” “কিত্তিবাস রামায়ণ” নামে বাংলাভাষায় সার্থক অনুবাদ করেন। এ হতে অন্যান্য ভাষায় সাম্প্রদায়িক ও আধ্যাত্মিকগ্রন্থাদি বাংলাভাষায় অনুবাদ করার শুভ সূচনা হয়। ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সারাপৃথিবীতে মাত্র ১০টি প্রধান শাস্ত্রীয়সংস্কার প্রতিষ্ঠিত ছিল। তখন বাঙালী মুসলমানের সংখ্যা ছিল প্রায় তিনকোটি (৩,০০,০০,০০০)।

ক্রমেক্রমে আরবি, ফার্সি, উর্দু ও সংস্কৃতভাষার অন্যান্য গ্রন্থাদির বঙ্গানুবাদ হলেও পবিত্র কুরানের বঙ্গানুবাদ তখন পর্যন্ত হয়নি। অবশেষে বাঙালী মুসলমানদের বাংলাভাষায় কুরান বুঝা ও জানার সুবিধার্থে ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দ হতে দীর্ঘ ছয় (৬) বছর একটানা অধ্যবসায় ও গবেষণার পর ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে গিরিশচন্দ্র সেন পবিত্র গ্রন্থটির সার্থক বঙ্গানুবাদ করার গৌরব অর্জন করেন। কিন্তু পারস্য হতে ইসলামী সাম্প্রদায়িক উদ্ভূত পরিভাষার ধ্বজাধারী পণ্ডিতরা দীর্ঘদিন এ বঙ্গানুবাদটি গ্রহণ না করার ফলে গ্রন্থটি তেমন জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি। পালিভাষায় রচিত বৌদ্ধ সাম্প্রদায়িকশাস্ত্র “ত্রিপিটক” চলতি ২০১২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলাভাষায় পরিপূর্ণ বঙ্গানুবাদ করা সম্ভব হয়নি কোন অনুবাদকের পক্ষেই।

অতীত অবলোকন
প্রায় বারোশত (১২০০) বছর পূর্বে সৃষ্টি আমাদের এ বাংলাভাষা, বর্তমান বিশ্বাক্সগনে ৬ষ্ঠ স্থানে প্রতিষ্ঠিত হোলেও বাংলাভাষার শব্দকোষ, শব্দভাণ্ডার বা বাংলা অভিধানাদি এখন পর্যন্ত বিশ্বাক্সগনে কিম্বা ব্যবহারিক ক্ষেত্রে প্রায় শিশু।
উল্লেখ্য (১৪১৪-১৪৪২) খ্রিস্টাব্দে যখন আদি “বাল্মীকি রামায়ণ” বাংলাভাষায় “কিত্তিবাস রামায়ণ” নামে অনুবাদ করা হয় তখন বাংলাভাষায় প্রণীত কোন অভিধানের কথা কল্পনা করাই বাহুল্য। ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে যখন পবিত্র গ্রন্থটির বক্সগানুবাদ করা হয় তখন বাংলাভাষায় কোন অভিধানের কথা কল্পনা করা যায় না। যতসম্ভব জানা যায় ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সর্বপ্রথম বাংলা শব্দ গঠন ও উচ্চারণের জন্য একটি বাংলা উচ্চারণ অভিধান প্রণয়ন করে। সম্ভবত এটিই বাংলাভাষার সর্বপ্রথম অভিধান। এ হতেই বাংলাভাষায় অভিধান প্রণয়নের ধারা সূচনা হয়।

গত ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে পূর্বপাকিস্তানে বাংলাভাষায় অভিধান প্রণয়নের সর্ব প্রথম প্রকল্প গৃহীত হয়। ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তা আংশিক প্রকাশ করা হয়। অতঃপর ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে পরিপূর্ণ বাংলা অভিধান বাংলাদেশে প্রকাশিত হয়। ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে অভিধানটির পুনঃসংস্করণ প্রকাশিত হয়। গত ১৪/১২/০২ খ্রিস্টাব্দে মোট ভুক্তি ৩২,৭৩৭ টি এবং ভুক্তি ও উপভুক্তিসহ মোট ৭৩,২৭৯টি শব্দের অভিধা নিয়ে বাংলা একাডেমি (বাংলাদেশ) কর্তৃক বর্তমান “ব্যবহারিক বাংলা অভিধান” টি প্রণীত হয়।

পর্যবেক্ষণ
ওপরোক্ত তথ্যাদির ভিত্তিতে বলতে পারি গত ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে যেসব গ্রন্থাদি বাংলাভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল, তা একান্ত অনুবাদকগণের চেষ্টা ও প্রয়াসপ্রসূত। কারণ কোন গ্রন্থের অনুবাদ বা ভাষান্তর করতে হোলে অবশ্যই ভাষান্তরকৃত ও ভাষান্তরিত উভয় ভাষার অভিধান একান্ত প্রয়োজন। তা না হোলে “রামায়ণ” ও “কুরান” এর মতো এহেন মহাগ্রন্থাদি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অর্জিতশব্দাদির দ্বারা অনুবাদ বা ভাষান্তর করা কারো পক্ষে কখনই সম্ভব নয়। কেউ যদি উভয় ভাষার অভিধান ব্যতীত মতগড়াভাবে কোন সাধারণ গ্রন্থেরও অনুবাদ করে থাকেন তবে তা সর্বসাধারণের গ্রহণযোগ্য নয়।

এবার (১৯৩৬-২০১০) খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রণীত ১.বাংলা-বাংলা, ২.বাংলা-ইংরেজি, ৩.বাংলা-আরবি, ৪.ইংরেজি-বাংলা, ৫.আরবি-বাংলা, ৬.ফার্সি-বাংলা, ৭.উর্দু-বাংলা, ৮.হিন্দি-বাংলা ও ৯.পালি-বাংলা অভিধানাদির মধ্যে রূপকশব্দাদি বা আধ্যাত্মিকদৈবিকাদির কোন শব্দেরই অভিধা যে প্রণয়ন করা হয়নি তা নিচে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

“আজ পাশাখেলবরে শ্যাম, ও শ্যামরে তোমার সনে
একেলা পেয়েছিরে শ্যাম, এ নিধুবনে।”
ধরি ওপরোক্ত চরণমালায় উদ্ধৃত “পাশাখেলা”, “শ্যাম” ও “নিধুবন” এ তিনটি শব্দের অভিধা আমাদের জানা প্রয়োজন বিধায় আমরা এখন বিভিন্ন অভিধান হতে উক্ত শব্দত্রয়ের অভিধা জানার চেষ্টা করব।

১. বাংলাদেশের ব্যবহারিক বাংলা অভিধান (ব্যাঞ্জনবর্ণ অংশ)
পাশাখেলা ক্রি নেই।

২. ব্যবহারিক বাংলা অভিধান (বাংলা একাডেমি)
পাশাখেলা ক্রি নেই।

৩. ব্যবহারিক শব্দকোষ (বাংলাভাষার অভিনব অভিধান)
পাশাখেলা ক্রি নেই।

৪. আধুনিক বাংলা বানান (অর্থ উচ্চারণ অভিধান)
পাশাখেলা ক্রি নেই।

ওপরোক্ত অভিধানাদির কোনটির মধ্যেই বাংলা ‘পাশাখেলা’ শব্দটি গ্রহণ করাই হয়নি তাহলে আমরা‘পাশাখেলা’ শব্দটির অভিধা জানব কিভাবে? প্রতিটি ভাষার গোড়া হলো অভিধান। সেই অভিধানেই যদি না থাকে তবে গোড়ায় ভুল। আর যার গোড়ায় ভুুল তার আগা-মাথায় কী থাকতে পারে তা অতি সহজেই অনুমান করা যায়। প্রমাণ করার জন্য নয় কেবল একান্ত প্রয়োজনেই আমরা এরূপ পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছি।

সমাধান
পাশাখেলা (রূপ)বি নর ও নারির মধুময় মিলন (আবি)বি সঙ্গম, সহবাস, কেলি, গমন, মিলন, মৈথুন, সম্ভোগ(অশি)বি চুদ, চুদন, চুদা, সেক্সুয়াল ইন্টারকর্স (sexual intercorce), ওয়াতিউ (.ﻭﻄﻰ), জিমাউ (.ﺠﻤﺎﻉ), লাওয়াতাত (.ﻟﻮﺍﻄﺔ) (আঞ্চ)ক্রি করা, লাগানো, গুয়ানো (আভা)বি অক্ষক্রীড়া, কাম, কেলি, গোষ্ঠখেলা, দ্যূতক্রীড়া, নিত্যকর্ম, বপ্রকেলি, বপ্রক্রীড়া, বাইচালি, জার্নি (jurney) (আপ্র)  সঙ্গম পরিবারের সদস্য ও রূপকসাহিত্যের একটি পরিভাষা বিশেষ (সংজ্ঞা) নর ও নারির মধুর মিলনকে সঙ্গম বা পাশাখেলা বলে(আপ)বি সালাত (.ﺻﻠﻮﺓ), বন্দেগি (ফা.ﺒﻧﺪﮔﻰ) (ইপ)বি র‌্যাপ (rape), কোপুলেশন (copulation) (উপ)বি  উপাসনা, পূজা, হোম, প্রেয়ার (prayer), ইবাদত (.ﻋﺑﺎﺪﺖ) (রূ)বি পাশাখেলা (দেত)বি কাম।

এবার নিচে “শ্যাম” শব্দটির কয়েকটি অভিধান অবিকল তুলে ধরা হলো।
১. বাংলাদেশের ব্যবহারিক বাংলা অভিধান (ব্যাঞ্জনবর্ণ অংশ)
শ্যাম বিণ  ১.মেঘবর্ণ, কালোবর্ণ, কৃষ্ণবর্ণ, ঘননীলবর্ণ ২.বিণ ফর্সা বা গৌরাঙ্গ এমন ৩.বিণ সবুজবর্ণ ৪.বিকৃষ্ণ।

২. ব্যবহারিক বাংলা অভিধান (বাংলা একাডেমি)
শ্যাম বিণ  ১.মেঘবর্ণ, কৃষ্ণবর্ণ, কালোবর্ণ, ঘন নীলবর্ণ  ২.ফর্সা ও গৌরাক্সগ এমন  ৩.সবুজবর্ণ (শ্যাম দূর্বাদল)৪.কৃষ্ণ।

৩.ব্যবহারিক শব্দকোষ (বাংলাভাষার অভিনব অভিধান)
শ্যাম বিণ কৃষ্ণবর্ণ, কৃষ্ণবর্ণবিশিষ্ট, সবুজ বি মেঘ, কোকিল, প্রয়াগস্থ বটবৃক্ষ বিশেষ, সামুদ্রিক লবণ, শ্রীকৃষ্ণ।

৪. আধুনিক বাংলা বানান-অর্থ-উচ্চারণ অভিধান
শ্যাম বি.বিণ মেঘবর্ণ, ঘন-নীলবর্ণ, কৃষ্ণবর্ণবিশিষ্ট।

বিভিন্ন অভিধান হতে প্রাপ্ত শব্দাদি
বিণ কালোবর্ণ, কালোরঙ, কৃষ্ণবর্ণ, কৃষ্ণবর্ণবিশিষ্ট, ঘন-নীলবর্ণ, মেঘবর্ণ, সবুজ, সবুজবর্ণ, ফর্সা বা গৌরাঙ্গ এমন বি কৃষ্ণ, শ্রীকৃষ্ণ, মেঘ, কোকিল, প্রয়াগস্থ বটবৃক্ষ বিশেষ, সামুদ্রিক লবণ।”

পর্যালোচনা (The discussion)
ওপরোক্ত শব্দাদির মধ্যে “কালোবর্ণ, কালোরঙ, কৃষ্ণবর্ণ, কৃষ্ণবর্ণবিশিষ্ট, ঘন-নীলবর্ণ ও মেঘবর্ণ” ইত্যাদি বাংলা ‘শ্যাম’ শব্দটির যথাশব্দ বা প্রকৃত অভিধা কিন্তু “সবুজ, সবুজবর্ণ ও ফর্সা বা গৌরাঙ্গ এমন” ইত্যাদি বাংলা “শ্যাম” শব্দটির যথাশব্দ কিম্বা অভিধা নয় বরং এ শব্দাদি বাংলা “শ্যাম” শব্দটির প্রকৃত অভিধা উদ্ঘাটনের জন্য ব্যবহৃত রূপকব্যাখ্যামূলক অভিধামাত্র। আবার “কৃষ্ণ, শ্রীকৃষ্ণ ও মেঘ” ইত্যাদি বাংলা ‘শ্যাম’ শব্দটির রূপকশব্দ বা দৈবিকা এবং “কোকিল, সামুদ্রিক লবণ ও প্রয়াগস্থ বটবৃক্ষ বিশেষ” ইত্যাদি বাংলা ‘শ্যাম’ শব্দটির ভিন্নভিন্ন অভিধা।

সমাধান
শ্যাম (রূপ)বি মেঘ, মেঘবর্ণ, কালোবর্ণ, কৃষ্ণবর্ণ (বাদৈ)বিণ ঈশ্বর, কাঁই, কাজলা, কালা, কালিয়া, কেলে, কৃষ্ণ, বিরিঞ্চি, ব্রহ্মা, শ্যামল, শ্যামলা (পরি) মানবদেহে প্রাপ্ত কালোবর্ণের জীবজল বা মধুবৎ মিষ্ট অমৃতসুধা, মানবদেহে আত্মা বা জীবনিশক্তি ধারণকারী বা বহনকারী কালো বর্ণের এক প্রকার রস। সাধু ও সন্ন্যাসিগণ এ শ্যামরস প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দর্শনলাভ করে কাঁইজি, ব্রাহ্মণ বা ব্রহ্মচারী উপাধিলাভ করে থাকেন (আবি)বিসৃষ্টিকর্তা, উৎপাদক, জনক, নির্মাতা, পিতা, ক্রিয়েটর (creator), অথার (autuor), খালেক্ব (.ﺨﺎﻟﻖ)(আভা)বি অগ্নি, অনাদি, অনন্ত, বিধাতা, বিবস্বান, স্বায়ম্ভু (আদৈ)বি আল্লাহ (.ﺍﻠﻠﻪ), ইসা (.ﻋﻴﺴﻰٰ), ইসামসিহ্ (.ﻋﻴﺲٰﻤﺴﻴﺢ), মসিহ (.ﻤﺴﻴﺢ), শাম (.ﺷﺄﻢ), শামস (.ﺸﻤﺲ), শিশ (.ﺸﻴﺶ) (ইদৈ)বি লর্ড (lord), মেকার (macker), প্রডিউসার (producer), ডিজাইনার (designier) (সংজ্ঞা) সৃষ্টিক্রিয়ার সরাসরি অংশগ্রহণকারী অনুঘটককে সৃষ্টিকর্তা বা শ্যাম বলে (আপ্র) সৃষ্টিকর্তা পরিবারের সদস্য ও রূপকসাহিত্যের একটি পরিভাষা বিশেষ (রূ)বি কাঁই (দেত)বি সৃষ্টিকর্তা।

অনুরূপভাবে নিচে “নিধুবন” শব্দটির কয়েকটি অভিধান অংশ অবিকল তুলে ধরা হলো।
১. বাংলাদেশের ব্যবহারিক বাংলা অভিধান (ব্যাঞ্জনবর্ণ অংশ)
নিধুবন১ (রূপ)বি মৈথুন, রমণ, শুক্রবিলাস, কামকেলি ২.বি আমোদ-প্রমোদ, ক্রীড়া-কৌতুক।
নিধুবন২ (রূপ)বি বিন্দাবনে অবস্থিত নিধু নামক বন, রাধাকৃষ্ণের কেলি-মালঞ্চ।

২. ব্যবহারিক বাংলা অভিধান (বাংলা একাডেমি)
নিধুবন (রূপ)বি বৃন্দাবনে অবস্থিত নিধু নামক বন, রাধা-কৃষ্ণের কেলি মালঞ্চ।

৩. ব্যবহারিক শব্দকোষ (বাংলাভাষার অভিনব অভিধান)
নিধুবন (রূপ)বি মৈথুন, শুক্রক্রিয়া, বৃন্দাবনের রাধাকৃষ্ণের লীলাস্থল বিশেষ।

৪. আধুনিক বাংলা বানান (অর্থ উচ্চারণ অভিধান)
নিধুবন (রূপ)বি নেই।

বিভিন্ন অভিধান হতে প্রাপ্ত শব্দাদি
বি মৈথুন, রমণ, শুক্রক্রিয়া, শুক্রবিলাস, কামকেলি, আমোদ-প্রমোদ, ক্রীড়া-কৌতুক, বিন্দাবনে অবস্থিত নিধুনামক বন, রাধাকৃষ্ণের কেলি-মালঞ্চ, বৃন্দাবনের রাধাকৃষ্ণের লীলাস্থল বিশেষ।”

পর্যালোচনা (The discussion)
ওপরোক্ত শব্দাদির মধ্যে “মৈথুন, রমণ, শুক্রক্রিয়া, শুক্রবিলাস, কামকেলি, আমোদ-প্রমোদ ও ক্রীড়া-কৌতুক” ইত্যাদি বাংলা ‘নিধুবন’ শব্দটির যথাশব্দ কিম্বা অভিধা নয়। আবার “বৃন্দাবনে অবস্থিত নিধুনামক বন, রাধাকৃষ্ণের কেলি-মালঞ্চ ও বৃন্দাবনের রাধাকৃষ্ণের লীলাস্থল বিশেষ” ইত্যাদি বাক্য বা বাংক্যাংশাদির মধ্যে একটিও বাংলা “নিধুবন” শব্দটির প্রকৃত অভিধা নয় বরং এসব হলো বাংলা ‘নিধুবন’ শব্দটির অভিধা উদ্ঘাটনের জন্য নির্মিত প্রপক বা রূপকব্যাখ্যা মাত্র।

সমাধান
নিধুবন (রূপ)বি নারিদেহ, রমণিদেহ, নারিচিহ্নধারী দেহ (প্র) বৃন্দাবনে অবস্থিত নিধু নামক বন, রাধাকৃষ্ণের কেলিমালঞ্চ (পরি) নারিদেহের রূপকদৈবিকা (আবি)বি নারিদেহ, ওম্যানবডি (woman body), ফিমেলবডি (female body), বাদনুজ্জাওঝা (.ﺒﺪﻦﺍﻟﺯﻮﺟﺔ) (আভা)বি নাগরদোলা, পাতাল, ভূমি (আপ)বি ইমরাত (.ﺍﻤﺮﺃﺓ), মারয়াত (.ﻤﺮﺀﺓ) (ইপ)বি ওম্যান (woman), ফিমেল (female) (আপ্র) নারিদেহ পরিবারের সদস্য ও রূপকসাহিত্যের একটি পরিভাষা বিশেষ (সংজ্ঞা) ভগচিহ্নধারী দেহকে নারিদেহ বা নিধুবন বলে (রূ)বিনিধুবন (দেত)বি নারিদেহ।

গত ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দ হতে বাংলাভাষায় অভিধানাদি প্রণয়নের শুভসূচনা হলেও অভিধানবেত্তাগণের অদূরদর্শিতা কিম্বা রূপকজ্ঞানের দৈন্যতা হেতু বাংলা ও সংস্কৃতভাষার রূপকশব্দাদি তাদের প্রণীত অভিধানাদি হতে ক্রমেক্রমেই বিলুপ্ত হতে থাকে। বর্তমানে কিছুকিছু রূপকশব্দ কোন কোন অভিধানে পাওয়া গেলেও তার অভিধা বা প্রকৃতসত্তাদি পাওয়া যায় না কোথাও। অনুরূপভাবে সংস্কৃত-বাংলা, ইংরেজি-বাংলা, আরবি-বাংলা, ফার্সি-বাংলা, উর্দু-বাংলা, হিন্দি-বাংলা ও পালি-বাংলা ইত্যাদি অভিধান প্রণয়নের সময়ে রূপকশব্দাবলিকে জলাঞ্জলি দেয়া হয়েছে চিরতরে। ফলে আমাদের বাংভারতীয় উপমহাদেশে আধ্যাত্মিকবিদ্যা চর্চা ও অনুশীলন বা গবেষণা ক্রমেক্রমে প্রায় দুর্লভ হয়ে পড়ে। পক্ষান্তরে গড়ে উঠে রূপকথার গুদামপচা গল্পকাহিনি ও লোমহর্ষক কিংবদন্তিময় উপন্যাস ও উপকথাদি।

আলোচনার উপসংহারে এসে এ কথা না বলে আর উপায় নেই যে, একশ্রেণির অভিধানবেত্তারা যেসব শব্দ বুঝেন না সেসব শব্দ অভিধানে সংযোজনও করেন না। আবার আরেক শ্রেণির অভিধানবেত্তারা আত্মতত্ত্বভিত্তিক অভিধাদিকে তাদের মনগড়াভাবে প্রণয়ন করে থাকেন। যেমন আরবি ক্বিয়ামত অর্থ- কেউ কেউ লিখেছেন ‘মহাধ্বংস’, আবার কিছুকিছু অভিধানবেত্তা আছেন তারা কোন্ কবি শব্দটিকে কী অর্থে ব্যবহার করেছেন তা তুলে ধরতে গিয়ে শব্দের মূল অভিধাই হারিয়ে ফেলেছেন। বিভিন্ন কারণেই আমাদের বাংভারতের অধিকাংশ অভিধানেই আধ্যাত্মিকশব্দ বা রূপকপরিভাষাদি নেই। একজন পাঠক কয়েক দিবস পর্যন্ত বিভিন্ন গ্রন্থগারে হন্নে হয়ে ঘুরেও ‘নিধুবন’ শব্দটির অভিধা অবগত হতে পারবেন না। এরূপ কারণেই আমাদের এসব আলোচনা। পরীক্ষার জন্য এরূপ আলোচনা নয় কেবল একান্ত প্রয়োজনেই এরূপ আলোচনার সম্মুখীন হয়েছি। অভিধানবেত্তারা আরো যত্নবান হলে আমরা এসব সমস্যার উত্তরণ করতে পারব বলে আমরা আশা করি।

(সংক্ষিপ্ত সংকলন)
তথ্যসুত্র- আধ্যাত্মিকবিদ্যা পরিচিতি- বলন কাঁইজি।

আত্মার প্রকারভেদ- ০২ (আত্মদর্শন, আত্মতত্ত্ব, আধ্যাত্মিকবিদ্যা, দিব্যজ্ঞান, দেহতত্ত্ব এবং বলন দর্শন নোট)

আত্মার প্রকারভেদ
আত্মা পাঁচ (৫) প্রকার- ১.ভূতাত্মা (পঞ্চভূত) ২.মানবাত্মা (মন), ৩.মহাত্মা (জ্ঞান) ৪.জীবাত্মা (সাঁই) ও পরমাত্মা (কাঁই)।

এছাড়াও নিম্নরূপেও আত্মার বিভাগ করতে দেখা যায়।
(ক) ১.ক্ষিতি ২.অপ ৩.তেজ ৪.মরুৎ ও ৫.ব্যোম (সংস্কৃত)।
(খ) ১.পরমাত্মা ২.ভূতাত্মা ৩.জীবাত্মা ৪.প্রেতাত্মা ও ৫.গোআত্মা (বাউল)।
(গ) ১.আগুন ২.জল ৩.মাটি ৪.বাতাস ও ৫.বিদ্যুৎ (আত্মতত্ত্ব)।
(ঘ) ১.পরমাত্মা ২.ভূতাত্মা ৩.জীবাত্মা ৪.আত্মারাম ও ৫.আত্মারামেশ্বর (পুরাণী)।
(ঙ) ১.রুহে জিসমানি (رُوحِ ﺟﺴﻤﺎﻨﻰ) ২.রুহে সুলত্বানি (رُوحِ ﺴﻟﻄﺎﻨﻰ) ৩.রুহুল আমিন (رُوحٌ ﺍﻟﻤﻴﻦ) ৪.রুহুল কুদুস (رُوحٌ ﺍﻟﻘﺪﺲ) ও ৫.রুহুল্লাহ (رُوحٌ ﺍﻠﻟﻪ) (কুরানী)।

আত্মার সমন্বয়সাধন
১.অপ ২.অলোক ৩.আগুন ৪.আত্মারাম ৫.আত্মারামেশ্বর ৬.ক্ষিতি ৭.গোয়াত্মা ৮.জল ৯.জীবাত্মা ১০.তেজ ১১.পরমাত্মা ১২.প্রেতাত্মা ১৩.বাতাস ১৪.ব্যোম ১৫.ভূতাত্মা ১৬.মরুৎ ১৭.মহাত্মা ১৮.মাটি ১৯.মানবাত্মা ২০.রুহুল আমিন (رُوحٌ  ﺍﻟﻤﻴﻦ) ২১.রুহুল কুদুস (رُوحٌ ﺍﻟﻘﺪﺲ) ২২.রুহুল্লাহ (رُوحٌ ﺍﻠﻟﻪ) ২৩.রুহে জিসমানি (رُوحِ ﺟﺴﻤﺎﻨﻰ) ও ২৪.রুহে সুলত্বানি (رُوحِ ﺴﻟﻄﺎﻨﻰ)। আত্মা সম্পর্কে প্রাপ্ত এসব পরিভাষাদির অভিধা বা অর্থ জেনে নেওয়ার পর আলোচনা করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে আমরা মনে করি বিধায় নিচে আত্মার পরিভাষাদির অভিধা তুলে ধরা হলো-
(ওপরোক্ত পরিভাষাগুলোর অবিধা জানতে মূল গ্রন্থ দেখুন)

দ্বিতীয় পর্ব... 

মানবাত্মা (মন)
 মানবাত্মা হলো জীবের মন। সর্ব জীবে ন্যূনাধিক মন থাকা সত্ত্বেও একে অন্য কোন নামে নামকরণ না করে মানবাত্মা বলার কারণ হলো- মানবাত্মা একমাত্র মানবের মধ্যেই সর্বাধিক সার্থক, সাবলীল ও শক্তিশালিরূপে দেখা যায়। সেজন্য এ আত্মাকে মানবাত্মা বলা হয়। 

মানবাত্মার সংজ্ঞা 
১. মানবীয় কার্যক্রম পরিচালনাকারী আত্মাকে মানবাত্মা বলে।
২. জ্ঞানিন্দ্রিয়াদির দ্বারা আহরিত ইঙ্গিত বা সংকেতাদির সাহায্যে জীবদেহ পরিচালনাকারী শক্তিকে মন বা মানবাত্মা বলে।
৩. মানবীয় আচার-ব্যবহারের ধারক বাহক শক্তিকে মন বা মানবাত্মা বলে।
৪. জীবের যাবতীয় কাজকর্ম পরিচালনাকারী সত্তাকে মন বা মানবাত্মা বলে।  

মানবাত্মার (মনের) প্রকারভেদ
 মানবাত্মা দ্বারা যেহেতু মন বুঝায় সেহেতু মানবাত্মার প্রকারভেদের স্থলে মনের প্রকারভেদ আলোচনা করাই যুক্তসঙ্গত হবে বলে আমরা মনে করি। নিচের মনের সংক্ষিপ্ত প্রকারভেদ আলোচনা করা হলো। 

মনের প্রকারভেদ
 মন চার প্রকার- ১.অচেতন মন ২.অবচেতন মন ৩.চেতন মন ও ৪.সচেতন মন। 

১.অচেতন মন

অচেতন বিণ অজ্ঞান, মূর্খ, সংজ্ঞাহীন, চেতনাহীন, চেতনাশূন্য, জড়, বাহ্যজ্ঞানহীন, মোহগ্রস্ত (দেপ্র)১.অচেতন ২.অবচেতন ৩.চেতন ও ৪.সচেতন- এ চার প্রকার মনের অন্যতম।

অচেতন মন বিণ চেতনাহীন মন, চেতনাশূন্য মন, চেতনা উদয় হওয়ার পূর্ববর্তী মন (দেপ্র) রূপকসাহিত্যের- ১.অচেতন মন ২.অবচেতন মন ৩.চেতন মন ও ৪.সচেতন মন- এ চার প্রকার মনের অন্যতম।

অচেতন মনের সংজ্ঞা
 মানবসন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর হতে চেতনা উদয় হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত মনকে অচেতন মন বলে।

অবচেতন মনের পরিচয়
যার আকার ও আয়তন আছে তাকেই পদার্থ বলে। পদার্থের সৃষ্টি ও ধ্বংস নেই, পদার্থের শুধু রূপান্তর রয়েছে(বিজ্ঞান)। তদ্রপ বিশ্বের কোন কিছুরই সৃষ্টি ও ধ্বংস নেই, শুধু রূপান্তর রয়েছে। তদ্রপ জীবকুলেও সৃষ্টি ও ধ্বংস নেই শুধু রূপান্তর রয়েছে। তদ্রপ জীবকুল বা প্রাণিকুলেরও সৃষ্টি ও ধ্বংস নেই কিন্তু রূপান্তর আছে। জীবকুল প্রাপ্ত বয়সে যার যার বীর্যের মধ্যে গিয়ে অবস্থান করে, উপযুক্ত পরিবেশ পেলে আবার বীর্যাধার ভেদ করে বেরিয়ে আসে। যেমন-  ধান। ধান শুধু তার বীর্যের মধ্যে প্রবেশ করে আবার যথাযথ ভূমিতে বপণ করলে, তা হতে অংকুর বেরিয়ে আসে। আবার তাতে অনুরূপ ধানই উৎপন্ন হয়। তদ্রপ বিশ্বের প্রতিটি জীবই যার যার বয়স অনুযায়ী অমোঘ প্রকৃতির রূপান্তর চক্রাধীন। 

মানুষ ও এক প্রকার জীব। প্রকৃতির এ অমোঘ রূপান্তর চক্রে মানুষ ঘূর্ণায়মান। জন্মগ্রহণের পর প্রাপ্ত বয়সে মানুষ আবার শুক্রে প্রবেশ করে। এ শুক্র গর্ভাশয়ে স্থাপন করলে মাত্র দশ (১০) মাসের ব্যবধানে সে আবার মানবসন্তানরূপে বেরিয়ে আসে। বীর্যাকারে গর্ভাশয়ে যায় আবার বেরিয়ে আসে। এটাই হলো-অমোঘ প্রকৃতির চিররূপান্তর জীবচক্র। 

প্রকৃতির রূপান্তর চক্রাধীন এ মানুষ শুক্ররূপে গর্ভাশয়ে প্রবেশ করার পর, কিছু সময়ের ব্যবধানে মানবসন্তানরূপে ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত, মানুষের মানসিক অবস্থা সম্পূর্ণ অচেতন থাকে। অর্থাৎ গর্ভস্থ ভ্রণ বা সন্তানের মন সম্পূর্ণ অচেতন অবস্থায় অবস্থান করে বিধায় জীবের গর্ভাবস্থার মনকে অচেতন মন বলে।

২.অবচেতন মন

অবচেতন বিণ অর্ধচেতন, অর্ধসজ্ঞান, subconscious (দেপ্র) ১.অচেতন ২.অবচেতন ৩.চেতন ও ৪.সচেতন- এ চার প্রকার মনের অন্যতম (পরি) কৈশোরকাল, প্রতিটি জীবের ক্ষেত্রে জন্ম হতে চন্দ্রচেতন বা কামোদ্দীপনা উদয় হওয়া পর্যন্ত সময়, মানুষের ক্ষেত্রে জন্ম হতে গড়ে ১৪ বছর সময়।

অবচেতন মন বিণ সম্পূর্ণ চেতনাহীন বা সম্পূর্ণ চেতনাবান নয় এরূপ মন, অচেতনও নয় আবার পরিপূর্ণ চেতনাও উদ্ভব হয়নি এরূপ মন, চন্দ্রচেতনা বা কামচেতনার উদয় হয়নি এরূপ মন (দেপ্র) রূপকসাহিত্যের- ১.অচেতন মন, ২.অবচেতন মন, ৩.চেতন মন ও ৪.সচেতন মন- এ চার প্রকার মনের অন্যতম।

অবচেতন মনের সংজ্ঞা
 ১.অচেতন নয় আবার চেতনও নয়, এরূপ মনকেই অবচেতন মন বলে।
২.মানবসন্তান জন্মগ্রহণ করার পর, তার চন্দ্রচেতনা (কামচেতনা) উদয় হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত মনকে অবচেতন মন বলে। 

অবচেতন মনের পরিচয়
মানবসন্তান জন্মগ্রহণের পর দেহ, আত্মা ও মন প্রকৃতিগতভাবেই অর্জন করে থাকে। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর নাসিকা যোগে বাতাসের মাধ্যমে অম্লজান সংযুক্ত হওয়ার সঙ্গেসঙ্গেই, মনের সৃষ্টি হয়। শৈশবকালে জীবের মনটি একেবারে শিশুই থাকে। শৈশবকাল অতিক্রম করে কৈশোরকালে পদার্পণের সঙ্গেসঙ্গেই জীবের মধ্যে চন্দ্রচেতনার অনুভব হতে থাকে। এ সময় জীবের মন অচেতনও থাকে না, আবার পরিপূর্ণ চেতনাও প্রাপ্ত হয় না। জীব মনের এ অবস্থাকেই মহাবিজ্ঞানে অবচেতন মন বলে ধরা হয়। 

সৃষ্টি জগতের সর্ব জীবের ক্ষেত্রে একমাত্র চন্দ্রচেতন হওয়াকেই জীবের যৌবনোন্মেষ হওয়া বা চেতন হওয়া বলে। চন্দ্রচেতন হওয়াকে জীবের চেতন হওয়া বলার কারণ হলো- পূর্বজন্মে জীবের যে কর্মের কারণে তাকে পরজন্মে আবার উদয় হতে হয়েছে- সে কর্মের চেতনা উদয় হওয়া। একমাত্র এ চন্দ্রচেতন অনুভূতি ব্যতীত অন্যান্য বিষয় বস্তু যেমন ছিল ঠিক তেমনই রয়েছে। যেমন-  হাত, পা, অঙ্গ-প্রত্যাঙ্গাদি, আকাশ, বাতাস, সূর্য-চন্দ্র সব কিছু যেমন ছিল ঠিক তেমনই রয়েছে। অমোঘ প্রকৃতির এ চিররূপান্তর চক্রাধীন জীবের শুধু চন্দ্রচেতনাটিই সাময়িক বন্ধ থাকে, আবার সক্রিয় হয়। জীবের গর্ভাবস্থান সময় হতে শৈশবকাল পর্যন্ত চন্দ্রচেতনা থাকে না। এছাড়া বিশ্বের চলমান অন্যান্য সৃষ্টির মধ্যে অন্য কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় না। 

বিশ্বের সব কিছুই চলমান। তদ্রপ সৃষ্টিগুলোও চলমান হওয়ার কারণে, কোন সৃষ্টির কোন শক্তির পরিবর্তন হয় না। একমাত্র জীবের চন্দ্রচেতনা শক্তিটি সাময়িক অচেতন ও অবচেতন হয় অর্থাৎ জীবের চন্দ্রচেতনা শক্তিটি সাময়িক বন্ধ থাকে। সারাসৃষ্টিজগতে শুধু এ পরিবর্তন টুকুই লক্ষ্য করা যায়। তা’ছাড়া সৃষ্টি জগতের সব কিছু যথানিয়মেই চলমান রয়েছে। 

৩.চেতন মন

চেতন বিণ প্রাণবান, জীবন্ত, সজীব, জ্ঞানযুক্ত, জ্ঞানবান, সংজ্ঞাবিশিষ্ট, জাগ্রত, চেতনা, সংজ্ঞা, জাগ্রত অবস্থা(রূপ)বি আত্মা, প্রাণ, জীবন, সত্ত্বা (দেপ্র) ১.অচেতন ২.অবচেতন ৩.চেতন ও ৪.সচেতন- এ চার প্রকার মনের অন্যতম।

চেতন মন বিণ চেতনাযুক্ত মন, বোধ ও বুদ্ধির উদয় হয়েছে এরূপ মন, চন্দ্রচেতনা বা কামচেতনার উদয় হয়েছে এরূপ মন (দেপ্র) রূপকসাহিত্যের- ১.অচেতন মন, ২.অবচেতন মন, ৩.চেতন মন ও ৪.সচেতন মন- এ চার প্রকার মনের অন্যতম।

চেতন মনের সংজ্ঞা
 জীবের চন্দ্রচেতনাযুক্ত মনকে চেতন মন বলে।
জীবের যৌবনকালকেই সাধারণত চেতন মানসিককাল ধরা হয়। জীবের মনে দুই প্রকার চেতনার উদয় হয়। সেজন্য মনকে আবার দুভাগে ভাগ করা হয়। যথা- ১.চন্দ্রচেতনগতভাবে চেতন মন ও ২.মানসিকভাবে চেতন মন। 

চন্দ্র (রূপ)বি চাঁদ, শশী, চন্দমা, চন্দন, নিশাকর, নিশাকান্ত, শশধর, হিমাংশু, সুধাংশু, সুধাকর, ইন্দু, বিধূ, মৃগাংক, শ্রেষ্ঠ, বাঙালী হিন্দুরে উপাধি বিশেষ, পৃথিবীর একটি উপগ্রহ- যা পৃথিবীকে মাসে একবার প্রদক্ষিণ করেবিণ চিত্তরঞ্জক, আনন্দদায়ক, আহ্লাদজনক, চন্দ্রের মতো সুন্দর (আপ্র) আধ্যাত্মিকবিজ্ঞানে বিশেষ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বস্তুর পরে ‘চাঁদ বা চন্দ্র’ শব্দটি প্রত্যয়ের মতো ব্যবহৃত হয় (গুরুচাঁদ, গুরুচন্দ্র), শব্দটি গুরুত্বপূর্ণশব্দাদির পরে বসে কিন্তু কখনো কখনো মূলশব্দের অর্থের পরিবর্তন ঘটায় না (রূনা)বি পরমগুরু, চোর(চরি)বি লালন (উপ)বি অমৃতসুধা, ননি, উপাস্য (রূ)বি সাঁই (দেত)বি পালনকর্তা।

চন্দ্রচেতনা (রূপ)বি কামচেতনা, মৈথুন আকাঙ্ক্ষা (প্র) কামক্ষুধা বা কামচেতনাকে রূপকসাহিত্যে রূপকার্থে চন্দ্রচেতনা বলা হয় (নচ)বি যম (রূ)বি আগুন।

চন্দ্রচেতনাগতভাবে চেতন মন
পূর্বজন্মের চন্দ্রচেতনাবৎ পুনঃচন্দ্রচেতন মন। অর্থাৎ জীবের পিতা-মাতারূপে অবস্থানকালে জীবের মধ্যে চন্দ্রচেতনার যে অবস্থা ছিল পরজন্মেও গর্ভাবস্থা শৈশব ও কৈশোরকাল অতিক্রম করে যৌবনকালে পদার্পণের সঙ্গেসঙ্গেই জীবের চন্দ্রচেতনা ঠিক পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসে। পরিপূর্ণ যৌবনকালে একটি জীবের মধ্যে ব্যক্তিত্বের যে যে উপাদানাদি বিদ্যমান থাকে পূর্ব জন্মেও জীবের মধ্যে ঠিক সে সে উপাদানই বিদ্যমান ছিল। অর্থাৎ যৌবনকালের পিতা-মাতা এবং যৌবনকালের ছেলে-মেয়ের মধ্যে ব্যক্তিত্বের উপাদানের বিন্দুমাত্র পার্থক্য নেই। এ হতেই বুঝা যায় জীবের মন সাময়িক অচেতন ও অবচেতন হলেও, যৌবনকালে পুনরায় পূর্বজন্মবৎ পরিপূর্ণ চেতনা প্রাপ্ত হয়। 

মানসিক বিণ মানত, কল্পনাপ্রসূত, কল্পনাজাত, মন সংক্রান্ত স্ত্রী মানসিকী।

মানসিকভাবে চেতন মন
 পূর্বজন্মে পিতামাতারূপ মানসপটে রিপু, রুদ্র ও দশাদির যেরূপ উপস্থিতি ছিল, পরজন্মের যৌবনকালের সন্তানের মানসপটে অবিকল তদ্রƒপই রিপু, রুদ্র ও দশাদির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। অর্থাৎ প্রাপ্তবয়স্ক পিতা-মাতা এবং প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে-মেয়ের মধ্যে মানসিক অবস্থা সম্পূর্ণ এক ও অভিন্ন।

ওপরোক্ত আলোচনা হতে বুঝা যায় যে, প্রকৃতির অমোঘ রূপান্তর চক্রাধীন মন গর্ভাবস্থায় অচেতন, শৈশব ও কৈশোরকালে অবচেতন থাকলেও যৌবনকালে পুনরায় পরিপূর্ণ চেতনা ফিরে পায়।  

৪. সচেতন মন
সচেতন বিণ জীবন্ত, জিয়ান, সতর্ক, সজাগ, সজ্ঞান, প্রাণবান, চেতনাবিশিষ্ট বিপ অচেতন (দেপ্র) ১.অচেতন ২.অবচেতন ৩.চেতন ও ৪.সচেতন- এ চার প্রকার মনের অন্যতম।

সচেতন মন বিণ চেতনাযুক্ত মন, বোধ ও বুদ্ধির উদয় হয়েছে এরূপ মন, আধ্যাত্মিকজ্ঞান বা পারম্পরিকজ্ঞান দ্বারা মনোশুদ্ধি বা আত্মশুদ্ধি করেছে এরূপ মন (দেপ্র) রূপকসাহিত্যের- ১.অচেতন মন, ২.অবচেতন মন, ৩.চেতন মন ও ৪.সচেতন মন- এ চার প্রকার মনের অন্যতম।

সচেতন মনের সংজ্ঞা
যে মনের কার্যকলাপ জ্ঞানের বিচার বিশ্লেষণ দ্বারা পরিচালিত হয় তাকে সচেতন মন বলে। 

সচেতন মনের পরিচয়
আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, মনের কোন জ্ঞান নেই। মন জীবের প্রকৃতিগত এক প্রকার শক্তি। মনের যেহেতু জ্ঞান নেই সেহেতু তাকে সচেতন বলার কারণ কী? প্রকৃতপক্ষে যার জ্ঞান নেই তার মধ্যে সচেতনতাও থাকতে পারে না। এরূপ চিরদ্বান্দ্বিক সম্বন্ধপদ ব্যবহার করার সূক্ষ্ম সমাধাটি নিচে তুলে ধরা হলো।

জীবের যৌবনকালে মন যখন মানসিকভাবে চেতন হয়, তখন মনের মাঝে তার চিরসাথী ও চিরসঙ্গী রিপু, রুদ্র ও দশাদিও এসে উপস্থিত হয়। এ রিপু, রুদ্র ও দশাদির কারণে, পরিবার ও সমাজে সৃষ্টি হয় মারামারি ও হানাহানি। তারপর সৃষ্টি হয় লুণ্ঠন ও প্রাণহানি। মানব মনের রিপু, রুদ্র ও দশাদির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব হতেই এসব ঘটনাদি সংঘটিত হয়। মানসপট হতে এসব ধ্বংসাত্মক বা মানবতা বিধ্বংসী সদস্যাদি অপসারণের জন্য চেতন মনকে দিব্যজ্ঞানের নিকট শিষ্যত্ববরণ করাতে হয়।

দিব্যজ্ঞান থাকে দিব্যজ্ঞানির নিকট বিধায় চেতন মনের মানসপট হতে অপরিপু দূর করানোর জন্য তাকে একজন দিব্যজ্ঞানির নিকট শিষ্যত্ববরণ করাতে হয়। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে মনের জ্ঞান নেই তবে মনের শিষ্যত্ব বরণের প্রয়োজন কী? উত্তরে বলা যায়- মন ও জ্ঞান সর্বসময় একই পাত্রে যুগপদরূপে বিদ্যমান বিধায় মন শাসনের জন্য জ্ঞানের যথাযথ জ্ঞান প্রয়োজন। তাই তো প্রবাদ বলে- “জ্ঞানী যায় জ্ঞানির কাছে, চৈতন্যজ্ঞান পাবার আশে।” একজন স্বল্পজ্ঞানী চৈতন্যজ্ঞানির নিকট ধারাবাহিকভাবে জ্ঞানার্জন করতে করতে যখন চৈতন্যজ্ঞান বা দিব্যজ্ঞান সাগর হতে চৈতন্যজ্ঞান প্রাপ্ত হন তখন তিনি নিজেই দিব্যজ্ঞানী হয়ে যান। দিব্যজ্ঞানী নিজের জ্ঞান দ্বারা নিজের মন শাসন করতে পারেন। অর্থাৎ নিজের জ্ঞানের নিকট নিজের মনকে শিষ্যত্ববরণ করাতে পারেন।

যেমন-  লালন সাঁইজি লিখেছেন- “(দেহের গুরু আছে কেবা, শিষ্য হয়ে কে দেয় সেবা, যেদিন তাই জানতে পাবা, কুলের ঘোর যাবে তখন- লালন-২২৩/৩)” জীবদেহের জ্ঞানকে বলা হয় গুরু এবং মনকে বলা হয় শিষ্য।

মানুষের ক্ষেত্রে বলা যায়- সাধারণ মানুষ কোন চৈতন্যজ্ঞানী বা দিব্যজ্ঞানী গুরু বা গোঁসাইয়ের নিকট শিষ্যত্বপদ গ্রহণ করে, যথাযথ আধ্যজ্ঞান অর্জন করে যখন নিজের জ্ঞান দ্বারা নিজের মনকে শাসন করতে থাকে, তখন সে লোকের দ্বারা কোন প্রকার পাপাদি কর্ম সংঘটন হয় না। নিষ্কলুষ ও নিষ্পাপ মনকেই সচেতন মন বলা যায়। তবে মন যেহেতু কোন প্রকার জ্ঞান রাখে না, সে ক্ষেত্রে মনের সচেতন হওয়া ও না হওয়া উভয়ই সমান। তাই বলা যায়- এ সমস্যা সমাধানের জন্য “সচেতনমন” বিশেষণটির পরিবর্তে “সচেতনব্যক্তি” বলাই যুক্তিযুক্ত ছিল। উত্তরে বলা যায়, যেহেতু এখানে মনের প্রকার ভেদ নিয়েই আলোচনা হচ্ছে বিধায় বিশেষণটিও মনের সম্বন্ধ পদ হওয়াই যুক্তিযুক্ত বিধায় “সচেতন মনের” পরিবর্তে “সচেতনব্যক্তি” বলা সিদ্ধ হবে না। এখানে মনের অবস্থার বিভাগের কারণে একান্ত নিরুপায় হয়েই এরূপ অসঙ্গত, দ্বান্দ্বিক ও সাংঘর্ষিক সম্বন্ধ পদটি ব্যবহার করা জন্য পাঠককুলের নিকট ক্ষমাপ্রার্থী। 

পরিশেষে বলা যায় মনের সচেতনতা বলতে, ব্যক্তির সচেতনতাই বুঝায়। প্রতিটি জীবের পুনর্জন্মের পর মন প্রকৃতিগতভাবেই চেতন হয় বটে কিন্তু সচেতন হয় না। মন সচেতন করতে হলে, কোন দিব্যজ্ঞানির নিকট হতে দিব্যজ্ঞান অর্জন করেই চেতন মনকে পুনঃসচেতন করতে হয়। এ হতেই আদিকালে গুরু ও শিষ্য পরম্পরার সৃষ্টি হয়। পূর্বকালে প্রতিটি মানুষই দিব্যজ্ঞান অর্জন করার জন্য কোন না কোন দিব্যজ্ঞানী গুরুর নিকট শিষ্যপাঠ গ্রহণ করতেন এবং পরম্পরার মাধ্যমে আধ্যজ্ঞান অর্জন করতেন বিধায় বিগত প্রায় ১০০০ বছর পূর্বেও অসংখ্য দিব্যজ্ঞানী মহান ব্যক্তিত্বের সন্ধান পাওয়া যায়। যেমন- বেদব্যাস, বুদ্ধদেব, হযরত মুহাম্মদ, জারির তাবারি, ইবনে জারির ইত্যাদি। কিন্তু বিগত প্রায় একসহস্র (১,০০০) বছর পূর্ব হতে পরম্পরার কৃত্রিম উপধারার উৎপত্তি হয়। পরম্পরার এ কৃত্রিম উপধারার ধ্বজাধারিরা পরম্পরাকে পুঁজি করে লাখে লাখে শিষ্য করেন বটে কিন্তু দিব্যজ্ঞান বা আধ্যজ্ঞান প্রদান না করে সাম্প্রদায়িক অন্ধবিশ্বাসের ওপর আবার পরম্পরার অন্ধবিশ্বাসের মরণনিগঢ়ে আবদ্ধ করে সাম্প্রদায়িক কিছু পরিভাষা ও নীতিমালার জ্ঞান দান করে বলে দেন যে এসবই আধ্যাত্মিকজ্ঞান। সে কারণে আমাদের বাংভারতীয় উপমহাদেশের হতভাগ্য সরলমনা বাঙালিরা গত এক সহস্রবছর পূর্ব হতে প্রকৃত আধ্যাত্মিকজ্ঞান হতে চিরবঞ্চিত।

এছাড়া মনকে আরো দুইভাগে ভাগ করা যায়। যথা- ১. সুমন ২. কুমন। 

১.সুমন 
সুভাববিশিষ্ট মনকে সুমন বলে। 
২.কুমন
 কুভাববিশিষ্ট মনকে কুমন বলে। 

মানবাত্মা বা মনের সদস্যাদি
মানবাত্মা বা মনের মন্দা ও ভালা দু’টি পক্ষ রয়েছে। তারাই মানবাত্মা বা মনকে কলুষিত করে থাকে। নিচে তাদের সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হলো।

মনের মন্দাপক্ষ
মনের মন্দাপক্ষের গোষ্ঠী চতুষ্টয় হলো- ১.রিপু, ২.রুদ্র, ৩.মন্দা ও ৪.দশা। 

রিপু
রিপু ৬টি। যথা- ১.কাম ২.ক্রোধ ৩.লোভ ৪.মোহ ৫.মদ ও ৬.মাৎসর্য্য।

রুদ্র
রুদ্র ১১টি। যথা- ১.অজ্ঞতা ২.অন্ধত্ব ৩.অন্যায় ৪.উগ্রতা ৫.তাণ্ডব ৬.হতাশা ৭.ব্যর্থতা ৮.ঘৃণা ৯.বৈরাগ্য ১০.অসন্তোস ও ১১.হত্যা। 

মন্দা
মন্দা ১০ প্রকার। যথা- ১.অহংকার ২.হিংসা ৩.শত্র“তা ৪.রাগ ৫.কুৎসা ৬.লিপ্সা ৭.মিথ্যা ৮.কৃপণতা ৯.কলা ও ১০.আমিত্ব।

দশা
দশা ১০ প্রকার। যথা- ১.উদ্বেগ ২.জাগরণ ৩.কুড়েমি ৪.মলিনতা ৫.প্রলাপ ৬.ব্যাধি ৭.উম্মাদ ৮.অশান্তি  ৯.ভুল ও ১০.জরা।

মনের ভালাপক্ষ
মনের ভালাপক্ষের সদস্যাদি ১০টি- ১.প্রতীজ্ঞা, ২.ধৈর্য, ২.প্রশংসা ৪.সাহস ৫.নিষ্ঠা ৬.ভয় ৭.তৃপ্তি ৮.প্রেম ৯.অভিনিবেশ ও ১০.গণনা। 
বিস্তারিত জানার জন্য আমাদের প্রণীত ‘আত্মতত্ত্ব ভেদ’ ৫ম খণ্ড গ্রন্থটি দেখার জন্য অনুরোধ রইল। 

মনের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
মানব সন্তান জন্মগ্রহণ বা বিকশিত হওয়ার পর মানবাত্মা বা মনের উৎপত্তি হয়। বিশেষভাবে মানবের মধ্যে মনের বিদ্যমানতা অত্যধিক পরিলক্ষিত হয় বলে, মনকে মানবাত্মা বলা হয়। মন উৎপত্তি হওয়ার পর একেবারে শিশু অবস্থায় থাকে। ক্রমেক্রমে মন পূর্ণভাবে বিকশিত হয়। 

মানব মন বা মানবাত্মার উৎপত্তিকাল সম্বন্ধে দার্শনিকগণ বলেন যে- মন বা মানবাত্মা ব্যক্তির ভিন্ন ও স্বাধীন কোন সত্তা নয়। এটি জ্ঞান নামক সত্তারই ভিন্ন একটি পরিভাষা মাত্র। তারা আরো বলে থাকেন যে- মূল বৈক্তিকসদস্য মাত্র তিনটি যথা- ১.দেহ ২.আত্মা ও ৩.জ্ঞান। এ জ্ঞানকেই চৈতন্যসত্তা, বিবেক বা মন ইত্যাদি নামে ডাকা হয়ে থাকে। প্রকৃতপক্ষে একজন ব্যক্তির নিকট দেহ, আত্মা ও জ্ঞান এ তিনটি মৌলিকসত্তা ভিন্ন অন্য কোন সত্তার অস্তিত্ব নেই। এ সূত্র হতেই দার্শনিকগণ বলেন যে- ব্যক্তির মধ্যে মন বা মানবাত্মা বলে মৌলিক বা প্রকৃত কোন আত্মা বা সত্তা নেই। 

তবে মন (মানবাত্মা) বা জ্ঞান যায়-ই বলি না কেন ব্যক্তির দেহ ও আত্মার পরে তৃতীয় একটি সত্তার অস্তিত্ব সবাই স্বীকার করে থাকেন। এ তৃতীয়সত্তাকেই আধ্যাত্মিকবিজ্ঞানে মানবাত্মা বা মন বলা হয়। এ তৃতীয়সত্তারটির উৎপত্তি সম্পর্কে দার্শনিকগণ ধারণা করেন যে- প্রথমে আত্মা ও পরে দেহ সৃষ্টির পর যখন আত্মা ও দেহ মিলিত হয়ে ব্যক্তিকে জীবন্ত করে তখন ব্যক্তির যাবতীয় জৈবিক কার্যাদি পরিচালনা করার জন্য তৃতীয় একটি সত্তার প্রয়োজন হয়। এ সত্তাটিই হলো মন বা জ্ঞান। ব্যক্তির এ শক্তিটি ব্যক্তির স্মরণশক্তি, বিচারশক্তি, বিশ্লেষণশক্তি বা অনুধাবনশক্তি ইত্যাদি নামে পরিচিত। 

ইতিমধ্যে অনেক দার্শনিক উল্লিখিত শক্তিগুলোর সমন্বিত রূপকেই মানবাত্মা বা মন বা জ্ঞান বলে অভিহিত করেছেন। উল্লেখ্য আমাদের প্রণীত ‘আত্মতত্ত্ব ভেদ’ ৫ম খণ্ড গ্রন্থটির মধ্যে আমরা মন ও জ্ঞানকে ভিন্নভিন্ন সত্তারূপে প্রমাণ করতে সমর্থ হয়েছি। 

ব্যক্তির দেহ ও জীবাত্মা হতেই মন বা মানবাত্মার উৎপত্তি। জীবন্তব্যক্তি যা কিছু দেখে, যা কিছু করে, যা কিছু শুনে ও যা কিছু অনুধাবন করে তার স্মৃতিভাণ্ডার, গবেষণা, উন্নয়ন ও উদ্ভাবন ইত্যাদি হতেই মানবাত্মা বা মনের উদ্ভব। মানবাত্মা বা মন কোন প্রাকৃতিকশক্তিও নয় আবার কোন পদার্থও নয় বরং এটি একটি কৃত্রিমশক্তি বিধায় এটি অন্য কোন উৎস্য হতে ব্যক্তির দেহে সংযুক্ত হয়েছে বলে প্রমাণ করাও সঠিক হবে না। 

পরিশেষে বলা যায় ব্যক্তির দেহ (আদিচতুর্ভূত- আগুন জল মাটি ও বাতাস) ও জীবাত্মার ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া হতেই মানবাত্মা বা মনের উদ্ভব হয়েছে। অতঃপর মনের মধ্যে ক্রমেক্রমে নিম্নোক্ত মন্দা ও ভালা স্বভাবাদি প্রবেশ করেছে। মন্দা ও ভালা স্বভাবাদি আবার পাঁচটি পরিবারে বিভক্ত যথা- ১.রিপু ২.রুদ্র ৩.মন্দা ৪.দশা ও ৫.ভালা।

এ পাঁচটি পরিবারের সদস্যাদি হলো- ১.কাম ২.ক্রোধ ৩.লোভ ৪.মোহ ৫.মদ ৬.মাৎসর্য্য ৭.অজ্ঞতা ৮.অন্ধত্ব ৯.অন্যায় ১০.উগ্রতা ১১.তাণ্ডব ১২.হতাশা ১৩.ব্যর্থতা ১৪.ঘৃণা ১৫.বৈরাগ্য ১৬.অসন্তোস ১৭.হত্যা ১৮.অহংকার ১৯.হিংসা ২০.শত্র“তা ২১.রাগ ২২.কুৎসা ২৩.লিপ্সা ২৪.মিথ্যা ২৫.কৃপণতা ২৬.কলা ২৭.আমিত্ব ২৮.উদ্বেগ ২৯.জাগরণ ৩০.কুড়েমি ৩১.মলিনতা ৩২.প্রলাপ ৩৩.ব্যাধি ৩৪.উম্মাদ ৩৫.অশান্তি ৩৬.ভুল ৩৭.জরা ৩৮.প্রতীজ্ঞা, ৩৯.ধৈর্য, ৪০.প্রশংসা ৪১.সাহস ৪২.নিষ্ঠা ৪৩.ভয় ৪৪.তৃপ্তি ৪৫.প্রেম ৪৬.অভিনিবেশ ও ৪৭.গণনা।

এসব সদস্যাদির বিস্তারিত বিবরণ আমাদের প্রণীত ‘আত্মতত্ত্ব ভেদ’ ৫ম খণ্ড গ্রন্থটির মধ্যে বর্ণনা করা হয়েছে। বিস্তারিত জানা ও বুঝার জন্য উক্ত গ্রন্থটি পাঠ করে নিতে পারেন। 

আমরা এখানে এতটুকুই বলতে চাই যে- মানবাত্মা বা মন একটি শিশুর মধ্যে প্রথমে একেবারে শূন্য হতেই উৎপত্তি হয়। অতঃপর ক্রমেক্রমে তা বিকশিত হতে থাকে। একসময় এ মানবাত্মার মধ্যে ওপরোক্ত সদস্যাদি এসে উপস্থিত হয় তখন মানবাত্মা পরিষ্কার বা পরিশুদ্ধ করার জন্য একজন পাকা গুরু নিকট শিষ্যত্ব গ্রহণ করে তাঁর সহচায্য গ্রহণ করতে হয়। তারপর গুরুর সাহায্যে মনের ভিতর হতে মন্দা সদস্যাদি বিতাড়ন করে ভালা সদস্যাদি প্রতিষ্ঠিত করতে হয়। তবে কেবল মানুষ পশুকুল হতে মানবকুলে পদার্পণ করতে পারে। নতুবা পশুকুলে জন্মগ্রহণ করে মানুষ পশুকুলেই রয়ে যায়। এককথায় গুরুদীক্ষা গ্রহণ করা ছাড়া কাঠামোগত মানুষ কোনদিনই পশুকুল হতে মানবকুলে আসতে পারে না। 

উপসংহারে বলা যায় আত্মার বিচার, আত্মার পুনরুত্থান, আত্মার জন্মান্তর ও আত্মার দোষগুণ আছে ইত্যাদি মতের প্রবক্তা দার্শনিক ও সাম্প্রদায়িক মতানুসারিগণ হয়ত এ মানবাত্মার কথাই বলে থাকেন। নচেত জীবের প্রকৃত জীবাত্মারূপ বিদ্যুৎশক্তিটি এরূপ কোন দোষে দোষী বা এরূপ কোন গুণে গুণী কখনই হতে পারে না।

(সংক্ষিপ্ত সংকলন)
তথ্যসূত্র- আত্মার সৃষ্টি রহস্য (আত্মমুক্তির পথ)- বলন কাঁইজি

আত্মার প্রকারভেদ- ০১ (আত্মদর্শন, আত্মতত্ত্ব, আধ্যাত্মিকবিদ্যা, দিব্যজ্ঞান, দেহতত্ত্ব এবং বলন দর্শন নোট)

আত্মার প্রকারভেদ
আত্মা পাঁচ (৫) প্রকার- ১.ভূতাত্মা (পঞ্চভূত) ২.মানবাত্মা (মন), ৩.মহাত্মা (জ্ঞান) ৪.জীবাত্মা (সাঁই) ও পরমাত্মা (কাঁই)।

এছাড়াও নিম্নরূপেও আত্মার বিভাগ করতে দেখা যায়।
(ক) ১.ক্ষিতি ২.অপ ৩.তেজ ৪.মরুৎ ও ৫.ব্যোম (সংস্কৃত)।
(খ) ১.পরমাত্মা ২.ভূতাত্মা ৩.জীবাত্মা ৪.প্রেতাত্মা ও ৫.গোআত্মা (বাউল)।
(গ) ১.আগুন ২.জল ৩.মাটি ৪.বাতাস ও ৫.বিদ্যুৎ (আত্মতত্ত্ব)।
(ঘ) ১.পরমাত্মা ২.ভূতাত্মা ৩.জীবাত্মা ৪.আত্মারাম ও ৫.আত্মারামেশ্বর (পুরাণী)।
(ঙ) ১.রুহে জিসমানি (رُوحِ ﺟﺴﻤﺎﻨﻰ) ২.রুহে সুলত্বানি (رُوحِ ﺴﻟﻄﺎﻨﻰ) ৩.রুহুল আমিন (رُوحٌ ﺍﻟﻤﻴﻦ) ৪.রুহুল কুদুস (رُوحٌ ﺍﻟﻘﺪﺲ) ও ৫.রুহুল্লাহ (رُوحٌ ﺍﻠﻟﻪ) (কুরানী)।

আত্মার সমন্বয়সাধন
১.অপ ২.অলোক ৩.আগুন ৪.আত্মারাম ৫.আত্মারামেশ্বর ৬.ক্ষিতি ৭.গোয়াত্মা ৮.জল ৯.জীবাত্মা ১০.তেজ ১১.পরমাত্মা ১২.প্রেতাত্মা ১৩.বাতাস ১৪.ব্যোম ১৫.ভূতাত্মা ১৬.মরুৎ ১৭.মহাত্মা ১৮.মাটি ১৯.মানবাত্মা ২০.রুহুল আমিন (رُوحٌ  ﺍﻟﻤﻴﻦ) ২১.রুহুল কুদুস (رُوحٌ ﺍﻟﻘﺪﺲ) ২২.রুহুল্লাহ (رُوحٌ ﺍﻠﻟﻪ) ২৩.রুহে জিসমানি (رُوحِ ﺟﺴﻤﺎﻨﻰ) ও ২৪.রুহে সুলত্বানি (رُوحِ ﺴﻟﻄﺎﻨﻰ)। আত্মা সম্পর্কে প্রাপ্ত এসব পরিভাষাদির অভিধা বা অর্থ জেনে নেওয়ার পর আলোচনা করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে আমরা মনে করি বিধায় নিচে আত্মার পরিভাষাদির অভিধা তুলে ধরা হলো-
(ওপরোক্ত পরিভাষাগুলোর অবিধা জানতে মূল গ্রন্থ দেখুন)

১. ভূতাত্মা
(১.আগুন ২.জল ৩.মাটি ৪.বাতাস ও ৫.বিদ্যুৎ)

ভূতাত্মা (রূপ)বি ভূতবৎ আত্মা, ভূতরূপ আত্মা (আবি)বি রূপকসাহিত্যের- ১.আগুন ২.জল ৩.মাটি ৪.বাতাস ও ৫.বিদ্যুৎ- এ পঞ্চাত্মার সমষ্টি।
আদিপঞ্চভূতের সমষ্টিকে রূপকসাহিত্যে ভূতাত্মা বলা হয়। {বাং.ভূত+ বাং.আত্মা}আত্মা (রূপ)বি প্রাণ, জীবন, জীবাত্মা (দেপ্র) পুরাণিদের মতে-১.পরমাত্মা ২.ভূতাত্মা ৩.জীবাত্মা ৪.আত্মারাম ও ৫.আত্মারামেশ্বর, কুরানিদের সাম্প্রদায়িক রূপকসংস্কার মতে- ১.রুহে জিসমানি (رُوحِ ﺟﺴﻤﺎﻨﻰ) ২.রুহে সুলত্বানি (رُوحِ ﺴﻟﻄﺎﻨﻰ) ৩.রুহুল আমিন (رُوحٌ ﺍﻟﻤﻴﻦ) ৪.রুহুল কুদুস (رُوحٌ ﺍﻟﻘﺪﺲ) ও ৫.রুহুল্লাহ (رُوحٌ ﺍﻠﻟﻪ), দেহ তাত্ত্বিকগণের মতে- ভূতাত্মা (পঞ্চভূত) মানবাত্মা (মন) মহানাত্মা (জ্ঞান), জীবাত্মা (সাঁই) ও পরমাত্মা (কাঁই), কোন কোন আত্মতাত্ত্বিকের মতে- ১.পরমাত্মা ২.ভূতাত্মা ৩.জীবাত্মা ৪.গোয়াত্মা ও ৫.প্রেতাত্মা (আবি)বি ১.আগুন ২.জল ৩.মাটি ৪.বাতাস ও ৫.বিদ্যুৎ- এ পঞ্চাত্মা।

ভূতাত্মার সংজ্ঞা
১. আধ্যাত্মিকবিজ্ঞানে জীব সৃষ্টির আদিপঞ্চভূতকে একত্রে ভূতাত্মা বলে। যথা- ১.আগুন ২.জল ৩.মাটি ৪.বাতাস ও ৫.বিদ্যুৎ।
২. জীব ও জড় সৃষ্টির, আগুন জল মাটি বাতাস ও অলোক- এ আদিপঞ্চোপাদানকে একত্রে ভূতাত্মা বলে।
৩. আদিচতুর্ভূতের প্রত্যেককেই ভূতাত্মা বলে। আদিচতুর্ভূত যথা- ১.আগুন ২.জল ৩.মাটি ও ৪.বাতাস। 
৪. জীব সৃষ্টির আদিভূতাদিকে ভূতাত্মা বলে, যেমন-  ১.আগুন।

আদিভূতাত্মা চার প্রকার- ১.আগুন ২.জল ৩.মাটি ও ৪.বাতাস। এ চতুর্ভূতের সমন্বয়ে অপর একটি অলৌকিকশক্তির উৎপত্তি হয়। সংক্ষেপে তাকে আলোক বা অলোক বা আলেক বলা হয়। মহাবিজ্ঞান বা আধ্যাত্মিকবিদ্যায় এ আলৌকিকশক্তিকেই জীবাত্মা বা আলেক বলে।

পবিত্র লালন হতেও ভূতাত্মার সন্ধান পাওয়া যায়। ‘লালন’ হতে ভূতাত্মার যে সন্ধান পাওয়া যায় তা নিচে তুলে ধরা হলো।
“জীবাত্মা পরমাত্মা, ভূতাত্মা আত্মারাম, আত্মা-রামেশ্বর দিয়ে পঞ্চাত্মা, এ ধড় হয় তাদের আস্তানা” (পবিত্র লালন-৫৪৯/২)।
সাধনবলে কখনো কখনো কোন কোন ভূতাত্মা সদস্যের হ্রাস-বৃদ্ধি করা যায়। যেমন- শ্বাস-প্রশ্বাস অধিক পরিমাণে গ্রহণ-বর্জনের দ্বারা সাময়িকভাবে দেহের তাপমাত্রা ইচ্ছেমত বৃদ্ধি করা যায়। আবার শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি নিয়ন্ত্রণ করে ইচ্ছেমত দেহকে বায়ু শূন্যও করা যায়। অধিক পরিশ্রম দ্বারা সাময়িক দেহের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করা যায়। এছাড়াও বিভিন্ন প্রকার রোগ ব্যাধির সময় জীবদেহে আদিচতুর্ভূতের অনেক হ্রাস-বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায়।আদিচতুর্ভূত জীবদেহ গঠনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ করে। তার মধ্যে জল ও বাতাস প্রত্যক্ষভাবে এবং আগুন ও মাটি পরোক্ষভাবে কাজ করে। জীব সরাসরি জল পান করে এবং শ্বাসরূপে বাতাস গ্রহণ করে কিন্তু আগুন ও মাটি জীবকুল সরাসরি গ্রহণ করতে পারে না। আগুন ও মাটি প্রক্রিয়াকরণ বা শোধন না করলে তা জীবকুল গ্রহণও করতে পারে না এবং তা জীবদেহ গঠনে অংশগ্রহণও করতে পারে না। প্রাণিকুল ফুসফুস, বৃক্ষকুল পাতা এবং মৎস্যকুল কানের ফুলকার সাহায্যে বাতাস হতে অম্লজান গ্রহণ করে। এভাবেই জীবকুল পরোক্ষভাবে অম্লজান গ্রহণ করে। আবার উদ্ভিদকুল মাটি হতে মাটির সারাংশ গ্রহণ করে যে শস্যাদি ও ফলাদি উৎপন্ন করে জীবকুল তা খেয়ে জীবন ধারণ করে। এভাবেই জীবকুল পরোক্ষভাবে মাটি গ্রহণ করে। ভিন্নভিন্ন অধ্যায়ে আদিপঞ্চভূত বা ভূতাত্মার বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

ভূতাত্মার প্রকারভেদ
ভূতাত্মা ৫ প্রকার। যথা- ১.আগুন আত্মা ২.জল আত্মা ৩.মাটি আত্মা ৪.বাতাস আাত্মা ৫.বিদ্যুৎ আত্মা।

১. আগুন আত্মা
আগুনের সংজ্ঞা
 দাহ্যশক্তিকে আগুন বলে।

আগুনের আধ্যাত্মিকসংজ্ঞা
 কাম বাসনাকে চন্দ্রচেতনা বা রূপকার্থে আগুন বলে।

আগুন আত্মার পরিচয়
আগুন প্রকৃত আত্মা নয়। তবে আগুন হলো- রূপকসাহিত্যে বর্ণিত আত্মতাত্ত্বিগণের নির্মিত,১.আগুন ২.জল ৩.মাটি ৪.বাতাস ও ৫.বিদ্যুৎ- এ পঞ্চাত্মার মধ্যে একটি। এটি বিশ্ব সৃষ্টির আদিপঞ্চভূতের অন্যতম ভূত। আত্মা ব্যতীত যেরূপ জীবের অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না, তদ্রপ এ আদিপঞ্চভূত ব্যতীত জীব সৃষ্টি কোন মতেই সম্ভব নয় বিধায় এদেরকে আত্মা বলা যায়। সৃষ্টির এ আদিউপাদানটির অধিক প্রয়োজন বিধায় আত্মার সাথে তুলনা করে এটিকে আত্মারূপে কল্পনা করা হয়েছে। জীবাত্মার প্রকৃত স্বরূপ আবিষ্কার হওয়ার পূর্বে বিশ্বসৃষ্টির আদিভূত আগুনকে আত্মা বলা যথেষ্ট হয়েছে। আত্মা ব্যতীত যেমন জীব বাঁচতে পারে না তদ্রপ আগুন  নামক এ আদিভূতটির অবর্তমানে বিশ্বের কোন প্রাণিই বাঁচতে পারে না।

২. জল আত্মা
জলের সংজ্ঞা
 সর্ব জীবের প্রাণ রক্ষাকারী সুপেয় তরল পদার্থকে জল বলে।

জলের আধ্যাত্মিকসংজ্ঞা
মাতৃজঠরে সর্ব জীবের ভ্রণ লালনকারী অমৃতরসকে পালনকর্তা বা রূপকার্থে জল বলে।

জল আত্মার পরিচয়
জল পরিভাষাটি জীবের প্রকৃত আত্মা নয়। জীবকুলকে বাঁচিয়ের রাখার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে জলকে আত্মা বলা হয়। জল হচ্ছে ভূতাত্মার সদস্য- যা বিশ্ব সৃষ্টির আদিপঞ্চভূতের অন্যতম। জীবাত্মা ব্যতীত যেরূপ জীবের অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না তদ্রপ আদিভূত জল ব্যতীত জীব সৃষ্টিরও কল্পনা করা যায় না বিধায় আদিপঞ্চভূতের সদস্য জলকে আত্মা বলা হয়। সৃষ্টির এ আদিউপাদানটির অধিক প্রয়োজন বিধায় আত্মার সাথে তুলনা করে এটিকে আত্মারূপে কল্পনা করা হয়েছে। বিশ্ব সৃষ্টির আদিভূত জলকে আত্মা বলা যথেষ্ট হয়েছে। আত্মা ব্যতীত যেমন জীব বাঁচতে পারে না তদ্রপ জল নামক এ আদিভূতটির অবর্তমানে বিশ্বের কোন প্রাণিই বাঁচতে পারে না। জীবকুলের বেঁচে থাকার জন্য আদিপঞ্চভূতের প্রয়োজনীয়তার ওপর নির্ভর করেই আদিপঞ্চভূত ভুক্ত “জল” নামক ভূতকে আত্মা বলা হয়েছে। জীবাত্মার প্রকৃত স্বরূপ আবিষ্কার হওয়ার পূর্বে এ ভূতকে আত্মা বলা যথার্থ ও যুক্তি সঙ্গত হয়েছে। রূপকসাহিত্যে জল দ্বারা মানবজল সাঁইকে বুঝায় এবং সাঁইকে আত্মা বলে। সাঁই বা পালনকর্তারূপ এ শুভ্রজল ব্যতীত যেহেতু কোন দ্বিপস্থ জীব সৃষ্টি হয় না এবং হতেও পারে না বিধায় সাঁইরূপ জীবজলকে আত্মা বলা যথার্থ। ফুলের মধ্যে এ সুমিষ্ট জল না থাকলে ফল হয় না। মাতৃজীবের মধ্যে এ সুপেয় জল না থাকলে সন্তান সৃষ্টি হয় না। এ জলের প্রয়োজনীয়তার আধিক্যের ওপর নির্ভর করেই একে আত্মা বলা হয়েছে। জল ও মানবজল সাঁইকে আত্মা বলা যথার্থ ও যুক্তিসঙ্গত হয়েছে।

৩. মাটি আত্মা
মাটির সংজ্ঞা
ভূপৃষ্ঠকে মাটি বলে।

মাটির আধ্যাত্মিকসংজ্ঞা
জীবের স্থূল আকারকে দেহ বা রূপকার্থে মাটি বলে।

মাটি আত্মার পরিচয়
মাটি পরিভাষাটির দ্বারা রূপকসাহিত্যে মানবদেহ বুঝানো হয়। আদিপঞ্চভূতের মধ্যে মাটি দ্বারাই যে দেহ নির্মিত হয় এ কথার ওপর প্রায় শতভাগ সাধু মনীষিগণই একমত। মাটি ভিন্ন অন্য কিছু দ্বারা জীব কাঠামো গঠন করা সম্ভব নয়। জীব কাঠামো না থাকলে আগুন, জল, বাতাস ও অলোক এবং আত্মা, মন ও জ্ঞান কিছুই রাখা সম্ভব হবে না। প্রাণ সঞ্চারের জন্য অতিব প্রয়োজনীয় এসব উপাদান না রাখতে পারলে কোন কোষ জীবন্ত হতে পারবে না। জীবদেহ গঠনের জন্য মাটির কোন বিকল্প নেই বলে মাটিকে দেহবৎ আত্মা বলা হয়। জীবাত্মার প্রকৃত স্বরূপ আবিষ্কার হওয়ার পূর্বে মাটিকে আত্মা বলা যথার্থ ও যুক্তি সক্সগত হয়েছে।

৪. বাতাস আত্মা
বাতাসের সংজ্ঞা
সর্ব জীবের প্রাণ রক্ষাকারী বায়বীয় (অম্লজান) পদার্থকে বাতাস বলে।

বাতাসের আধ্যাত্মিকসংজ্ঞা
নাসিকাযোগে চলাচলকারী শ্বাসকে বাতাস বলে।

বাতাস আত্মার পরিচয়
জীবকুল যেহেতু বাতাসের অম্লজান ছাড়া বাঁচতে পারে না। সেজন্য বাতাসকে রূপকসাহিত্যে আত্মা বলা হয়। শ্বাস গ্রহণের মাধ্যমে প্রাণিকুল নাসিকা দ্বারা ও মৎস্যকুল কানের ফুলকা দ্বারা বাতাস হতে অম্লজান গ্রহণ ও অঙ্গারাম্লজান বর্জন করে। আবার উদ্ভিদকুল পাতা বা ছাল দ্বারা বাতাস হতে অঙ্গারাম্লজান গ্রহণ ও অম্লজান বর্জন করে বলে রূপকসাহিত্যে শ্বাসরূপ বাতাসকে আত্মা বলা হয়। উল্লেখ্য বৈষয়িকসাহিত্যে বাতাস দ্বারা বায়ু বুঝায় কিন্তু রূপকসাহিত্যে বাতাস দ্বারা শ্বাস বুঝায়। অম্লজান ব্যতীত জীবকুল বাঁচতে পারে না বলে জীবাত্মার প্রকৃত স্বরূপ আবিষ্কার হওয়ার পূর্বে বাতাসের অম্লজানকে অর্থাৎ বাতাসকে আত্মা বলা যথার্থ হয়েছে। কিন্তু এখন আর বাতাসকে আত্মা বলা হয় না বরং বাতাসের অম্লজান ও অঙ্গারাম্লজান কেউ কেউ জীবের জীবাত্মা বলে থাকেন। আমরা এরূপ ধারণাকারিদের প্রতিবাদে বলব যে- বাতাস বা বাতাসের অম্লজান ও অঙ্গারাম্লজান কোনটিই প্রকৃত জীবাত্মা নয়। এ পদার্থদ্বয় জীবাত্মারূপ বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপাদান মাত্র। বিদ্যুৎ সৃষ্টির উপাদানকে বিদ্যুৎ বলা যায় না। তদ্রপ জীবাত্মা সৃষ্টির উপাদানকেও জীবাত্মা বলা যায় না। কিন্তু পূর্বকালে মনীষিদের ধারণা ছিল বাতাসই জীবদেহের জীবাত্মা। তাই তারা বাতাসকে জীবাত্মা ধরে অনেক ঐশিবাণী নির্মাণ করেছিলেন।

বিভিন্ন মহাগ্রন্থে বাতাসকে জীবাত্মা ধরে নির্মিত ঐশিবাণিগুলো নিচে তুলে ধরা হলো- পবিত্র কুরান হতে বাতাস আত্মার উদাহরণ
১. “فَإِذَا سَوَّيْتُهُ وَنَفَخْتُ فِيهِ مِنْ رُوحِي فَقَعُوا لَهُ سَاجِدِينَ” “অতঃপর যখন আমি তাকে সুঠাম করব এবং তার মধ্যে আত্মা ফুৎকার করব তখন তোমরা তাকে ভক্তি করবে” (কুরান, হিজর- ২৯)।
২. “فَإِذَا سَوَّيْتُهُ وَنَفَخْتُ فِيهِ مِنْ رُوحِي فَقَعُوا لَهُ سَاجِدِينَ” “অতঃপর যখন আমরা তাকে সুঠাম করব এবং তার মধ্যে আত্মা ফুৎকার করব, তখন তোমরা তাকে ভক্তি করবে” (কুরান, সোয়াদ- ৭২)
৩. “ثُمَّ سَوَّاهُ وَنَفَخَ فِيهِ مِنْ رُوحِهِ وَجَعَلَ لَكُمْ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَالْأَفْئِدَةَ قَلِيلًا مَا تَشْكُرُونَ” “অতঃপর তিনি তাকে সুঠাম করেছেন, তন্মধ্যে স্বীয় আত্মা ফুঁকে দিয়েছেন তাঁর নিকট হতে। তোমাদের দিয়েছেন কর্ণ, চক্ষু ও অন্তঃকরণ, তোমরা অতি সামান্যই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো” (কুরান, সিজদা- ৯)
৪. “وَمَرْيَمَ ابْنَتَ عِمْرَانَ الَّتِي أَحْصَنَتْ فَرْجَهَا فَنَفَخْنَا فِيهِ مِنْ رُوحِنَا وَصَدَّقَتْ بِكَلِمَاتِ رَبِّهَا وَكُتُبِهِ وَكَانَتْ مِنْ الْقَانِتِينَ” “হর্ম্যরে কন্যা অষ্ঠি যে স্বীয় জননেন্দ্রিয়কে সংরক্ষণ করেছিল অতঃপর আমরা তন্মধ্যে স্বীয় আত্মা ফুৎকার করেছিলাম। সে আপন প্রতিপালকের বাক্যাদি ও তাঁর গ্রন্থাদিকে সত্যতার সাথে গ্রহণ করেছিল এবং সে অনুগতাদের একজন ছিল” (কুরান, তাহরিম- ১২)

পবিত্র লালন হতে বাতাস আত্মার উদাহরণ
১. “আত্মারূপেতে কেবা, দেহভাণ্ডে করে সেবা, দেখ দেখ যেবা, হও মহাশয়” (পবিত্র লালন- ১০৫/২)
২. দেহের জরিব হয় নাইরে, মন তোর ভুল পড়েছে, ধড় ছেড়ে আত্মা গেলে মানুষ কী বাঁচে” (পবিত্র লালন- ৫৫১/১)
৩. মনেরমানুষ সত্য জেনে, বলো এখন যাও কোথায়, হাওয়ারূপে এ দেহে, আত্মা আসে আত্মা যায়” (পবিত্র লালন- ৭৬০/১)।
ওপরোক্ত উদ্ধৃতিগুলো হতে পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় যে- পদার্থ বিজ্ঞানিদের দ্বারা বাতাস বিভাজনের পূর্বে সাধু, গুরু ও গোঁসাই সবাই বাতাসকে আত্মা বলতেন। অতঃপর বিজ্ঞানিদের দ্বারা বাতাস বিভাজন হওয়ার পর দেখা যায় বাতাসের মধ্যে মোট ২৩টি পদার্থ বিদ্যমান। তার মধ্যে একটি পদার্থ হলো- অম্লজান (অক্সিজেন. oxygen)। এ পদার্থটি জীবদেহের বিদ্যুৎরূপ জীবাত্মা উৎপাদনে সাহার্য করে থাকে এবং অন্য একটি পদার্থ হলো- অঙ্গারাম্লজান (কার্বন ডাইয়ক্সাইড. carbon dioxide)। এ পদার্থটি উদ্ভিদের বিদ্যুৎরূপ জীবাত্মা উৎপাদনে সাহায্য করে থাকে। বাতাসের এ দু’টি পদার্থ ব্যতীত জীবকুল ও উদ্ভিদকুল এক মুহূর্তকালও বাঁচতে পারে না। এজন্যই পূর্বকালে বাতাসকে জীবের জীবাত্মা বলা হতো। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ পদার্থদ্বয় জীব বা উদ্ভিদ কোন আত্মা নয়। তবে পদার্থদ্বয় জীব ও উদ্ভিদের বিদ্যুৎরূপ জীবাত্মা উৎপাদনের উপাদান মাত্র।

৫. অলোক আত্মা
অলোকের সংজ্ঞা
 অলৌকিক বিষয়াবলিকে সংক্ষেপে অলোক বলে।

অলোকের আধ্যাত্মিকসংজ্ঞা
 জীবকোষ সৃষ্টি ও জীবিত রাখার দায়িত্ব পালনকারী শক্তিকে অলোক বলে।

অলোক আত্মার পরিচয়
অলোক পরিভাষাটির আভিধানিক অর্থ- “১.অলৌকিক, লোকাতীত, সাধ্যাতীত, মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় এরূপ, ইহলোকের নয় এরূপ ২.নির্জন, বিজন, অসাধারণ, লোক বসতিহীন (ব্য্য) অলৌকিক পরিভাষাটির সংক্ষিপ্ত রূপ।” যে সত্তা ব্যতীত জীবকুল বেঁচে থাকতে পারে না এবং যার কোন আকার প্রকার নেই এরূপ সত্তাকে অলোক বলা হয়। এটিই হলো জীবের প্রকৃত আত্মা। অর্থাৎ জীবাত্মার অপরনাম অলোক বা আলোক।  আদিপঞ্চভূত পরিচিতিপঞ্চভূতের একীভূত সমষ্টিই জীবের চৈতন্য। চৈতন্যতাই কাঁইসত্তা। পঞ্চভূত বিভূতি হতেই এ ক্ষুদ্র ও বৃহৎ পরিদৃশ্যমান জগৎ গঠিত হয়েছে। পঞ্চভূতের মধ্যে অলোকের একটি মাত্র গুণ। এ শক্তিটি কারো আশ্রয়ীভূত নয়। অলোক সৃষ্টি না হলে বিশ্বের কোন জীবই সৃষ্টি হতো না। অবশিষ্ট চারটি ভূতের অপার লীলার জন্যই অলোকশক্তির বিশেষ প্রয়োজন। এ অলোকের অভাবে সব সৃষ্টি অচল হয়ে পড়ত বিধায় সারাসৃষ্টিজগতের ওপর অলোকের শ্রেষ্ঠত্ব সর্বাধিক।

পঞ্চভূত তত্ত্ব বর্ণনা

“পঞ্চভূতে গঠিত হয় ত্রিসংসার
পঞ্চভূত বিনে কোন বস্তু নাই আর।
পঞ্চভূত তত্ত্বসহ বটে একরূপ
জীবাত্মা পরমাত্মা মিলে স্বরূপ।
পদার্থ শব্দের অর্থ করি যে বর্ণন
পঞ্চভূত নাম হয় পদার্থ গণন।
তত্ত্ব শব্দে পঞ্চতত্ত্ব পঞ্চভূতময়
শব্দ স্পর্শ রূপ রস গন্ধ হয়।
তত্ত্ব শব্দের অর্থ কহি শুনহ বিস্তার 
চতুর্বিংশ পঞ্চবিংশ মোহতত্ত্ব আর। 
ইহাকে জানিলে জীব জনমমুক্ত হয় 
অনিত্য দেহ নিত্য হয় জানিও নিশ্চয়। 
গুরু-শিষ্য এক আত্মা হইবে যখন 
নিত্য নিধুবনে যাবে করিবে সাধন। 
এ পঞ্চতত্ত্ব যে অবগত হয় 
সে জনমমুক্ত জানিয় নিশ্চয়।"

১.আগুন ২.জল ৩.মাটি ৪.বাতাস ও ৫.বিদ্যুৎকে একত্রে পঞ্চভূত বলা হয়। এ পঞ্চভূতের কোন ভূতের কী গুণ তা নিচে তুলে ধরা হলো।

১. আগুনের পঞ্চগুণ
যথা- ১.কাম ২.ক্ষুধা ৩.তৃষ্ণা ৪.নিদ্রা ও ৫.ভ্রান্তি।

২. জলের পঞ্চগুণ
যথা- ১.শুক্র ২.শোণিত ৩.জল ৪.মল ও ৫.মজ্জা।

৩. মাটির পঞ্চগুণ
যথা- ১.অস্থি ২.মাংস ৩.নখ ৪.ত্বক ও ৫.লোম।

৪. বাতাসের পঞ্চগুণ
যথা- ১.আলস্য ২.ক্রোধ ৩.লোভ ৪.মোহ ও ৫.লজ্জা। 

৫. অলোকের পঞ্চগুণ
যথা- ১.জীবন্ত ২.ঘুমন্ত ৩.অজ্ঞান ৪.মৃত ও ৫.নিত্য।

১. আগুন বশীভূত করতে হয় চর্চা ও গবেষণা দ্বারা,
২. জল বশীভূত করতে হয় নামকীর্তন দ্বারা,
৩. মাটি বশীভূত করতে হয় পারম্পরিক মানুষ গুরুর কৃপাবলে,
৪. বাতাস বশীভূত করতে হয় অভিনিবেশ বা ধ্যান দ্বারা,
৫. বিদ্যুৎ বশীভূত করার কোন পদ্ধতি এখনো আবিষ্কার হয়নি।

অলোক বশীভূত করার অর্থ আত্মার ওপর পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। আর আত্মা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে মানুষ মহাবিশ্বের জ্যোতিষ্কদের মতো চিরস্থায়ী হতে পারবে।

(সংক্ষিপ্ত সংকলন)
তথ্যসূত্র- আত্মার সৃষ্টি রহস্য (আত্মমুক্তির পথ)- বলন কাঁইজি