বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৩

আধ্যাত্মিকবিদ্যা ক্রমবিলুপ্তির কারণাদি (আত্মদর্শন, আত্মতত্ত্ব, আধ্যাত্মিকবিদ্যা, দিব্যজ্ঞান, দেহতত্ত্ব এবং বলন দর্শন নোট)

আধ্যাত্মিকবিদ্যা বা রূপকসাহিত্য পৃথিবীর বুক হতে বিলুপ্ত হওয়ার অধিক গুরুত্বপূর্ণ অনেকগুলো কারণ রয়েছে। একদিকে বাংলাভাষায় আজ পর্যন্ত কোন রূপকসাহিত্য নির্মিত হয়নি বিধায় সাম্প্রদায়িক ও পারম্পরিক কোন মতবাদও বাংলাভাষায় গড়ে উঠেনি। আধ্যাত্মিকবিদ্যা বিলুপ্ত হওয়ার কারণাদি নিচে সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরা হলো।

১. আধ্যাত্মিকশব্দাবলী অভিধানে সংকলন না করণ
পাঠক বা গবেষক মাত্রই জানেন যে, বর্তমান পৃথিবীতে প্রায় উনিশ (১৯)টি সাম্প্রদায়িকমতবাদ বিশ্বজনীনতা অর্জন করেছে। প্রায় সারাবিশ্বব্যাপী এ উনিশ (১৯) টি সাম্প্রদায়িকমতবাদের অনুসারিদের ন্যূনাধিক বসবাস করতে দেখা যায়। উক্ত মতবাদাদির শাখাপ্রশাখাসহ প্রায় কয়েক সহস্রের অধিক মতবাদাবলম্বী লোকের বসবাসের সন্ধান বর্তমান পৃথিবীতে পাওয়া যায়। বর্তমান বাংলাদেশেই প্রায় পঞ্চাশ (৫০) টিরও অধিক জাতিসত্তার মানুষ বাস করে।

প্রায় বারোশত (১,২০০) বছর পূর্বে আমাদের বাংলাভাষার সৃষ্টি। ব্যবহারের দিক হতে আমাদের বাংলাভাষা বর্তমান পৃথিবীতে ষষ্ঠস্থানে স্বভূমিকায় প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু বাংলাভাষায় কোন আধ্যাত্মিকগ্রন্থাদি না থাকায় প্রাণভরা আবেগ ও আকুতি থাকা সত্ত্বেও বাংলাভাষায় একটি শাস্ত্রীয়সংস্কার কিম্বা আধ্যাত্মিকনীতিমালা নির্মাণ করা বাঙালী গবেষক, চিন্তাবিদ ও সাম্প্রদায়িকমতবাদী পণ্ডিতগণের পক্ষে আজও সম্ভব হয়নি। কিন্তু একটি স্বাধীন ও স্বকীয় জাতির নিকট সাম্প্রদায়িকশাস্ত্র, শাস্ত্রীয়সংস্কার, মতবাদাবতারের প্রতি গভীর ভালোবাসা, সাম্প্রদায়িক গল্পকাহিনি ও সাম্প্রদায়িক উপন্যাসাদির প্রতি সম্মান কিম্বা প্রয়োজন মানুষের মৌলিক প্রয়োজনাদির চেয়ে কোন অংশে স্বল্প নয়।

গত ১৩০১ খ্রিস্টাব্দে ছুলত্বানি শাসকগণের দ্বারা সমগ্র বঙ্গদেশ স্বাধীন হয়। মূলত তখন হতেই বাঙালী গবেষক, চিন্তাবিদ, লেখক, কবি ও সাহিত্যিকগণের মধ্যে সাম্প্রদায়িকশাস্ত্র, শাস্ত্রীয়সংস্কার, মতবাদাবতারের প্রতি গভীর ভালোবাসা, সাম্প্রদায়িক গল্পকাহিনি ও সাম্প্রদায়িক উপন্যাসাদির প্রতি স্বাধীন বাঙালিদের ভালোবাসা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। কিন্তু বাংলাভাষায় সাম্প্রদায়িকশাস্ত্র, সাম্প্রদায়িক সংস্কার, সাম্প্রদায়িক গল্পকাহিনি ও সাম্প্রদায়িক উপন্যাসাদি না থাকায় অন্যান্য ভাষা হতে সাম্প্রদায়িক ও আধ্যাত্মিকগ্রন্থাদি বাংলাভাষায় অনুবাদ করার চরম ও পরম অভাব অনুভব করেন বাঙালী গবেষকগণ। কিন্তু মতবাদান্ধ, গোঁড়া ও চরমপন্থিদের কবলে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে অন্যান্য ভাষায় সাম্প্রদায়িকশাস্ত্রাদি কিম্বা আধ্যাত্মিকগ্রন্থাদি বাংলাভাষায় অনুবাদ করার তেমন সাহস করতেন না বাঙালী গবেষকগণ।

গত ১৪১৪ খ্রিস্টাব্দে রাজসভায় বাংলাভাষার ব্যবহার ও বাংলাভাষায় সাহিত্য রচনার স্বকীয়তালাভ করার পর হতে বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক মতবাদান্ধ চরমপন্থিদের গোঁড়ামিও ক্রমেক্রমে হ্রাস পেতে থাকে। ফলে কবি কিত্তিবাস সর্ব প্রথম সংস্কৃতভাষায় রচিত আদি “বাল্মীকি রামায়ণ” “কিত্তিবাস রামায়ণ” নামে বাংলাভাষায় সার্থক অনুবাদ করেন। এ হতে অন্যান্য ভাষায় সাম্প্রদায়িক ও আধ্যাত্মিকগ্রন্থাদি বাংলাভাষায় অনুবাদ করার শুভ সূচনা হয়। ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সারাপৃথিবীতে মাত্র ১০টি প্রধান শাস্ত্রীয়সংস্কার প্রতিষ্ঠিত ছিল। তখন বাঙালী মুসলমানের সংখ্যা ছিল প্রায় তিনকোটি (৩,০০,০০,০০০)।

ক্রমেক্রমে আরবি, ফার্সি, উর্দু ও সংস্কৃতভাষার অন্যান্য গ্রন্থাদির বঙ্গানুবাদ হলেও পবিত্র কুরানের বঙ্গানুবাদ তখন পর্যন্ত হয়নি। অবশেষে বাঙালী মুসলমানদের বাংলাভাষায় কুরান বুঝা ও জানার সুবিধার্থে ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দ হতে দীর্ঘ ছয় (৬) বছর একটানা অধ্যবসায় ও গবেষণার পর ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে গিরিশচন্দ্র সেন পবিত্র গ্রন্থটির সার্থক বঙ্গানুবাদ করার গৌরব অর্জন করেন। কিন্তু পারস্য হতে ইসলামী সাম্প্রদায়িক উদ্ভূত পরিভাষার ধ্বজাধারী পণ্ডিতরা দীর্ঘদিন এ বঙ্গানুবাদটি গ্রহণ না করার ফলে গ্রন্থটি তেমন জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি। পালিভাষায় রচিত বৌদ্ধ সাম্প্রদায়িকশাস্ত্র “ত্রিপিটক” চলতি ২০১২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলাভাষায় পরিপূর্ণ বঙ্গানুবাদ করা সম্ভব হয়নি কোন অনুবাদকের পক্ষেই।

অতীত অবলোকন
প্রায় বারোশত (১২০০) বছর পূর্বে সৃষ্টি আমাদের এ বাংলাভাষা, বর্তমান বিশ্বাক্সগনে ৬ষ্ঠ স্থানে প্রতিষ্ঠিত হোলেও বাংলাভাষার শব্দকোষ, শব্দভাণ্ডার বা বাংলা অভিধানাদি এখন পর্যন্ত বিশ্বাক্সগনে কিম্বা ব্যবহারিক ক্ষেত্রে প্রায় শিশু।
উল্লেখ্য (১৪১৪-১৪৪২) খ্রিস্টাব্দে যখন আদি “বাল্মীকি রামায়ণ” বাংলাভাষায় “কিত্তিবাস রামায়ণ” নামে অনুবাদ করা হয় তখন বাংলাভাষায় প্রণীত কোন অভিধানের কথা কল্পনা করাই বাহুল্য। ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে যখন পবিত্র গ্রন্থটির বক্সগানুবাদ করা হয় তখন বাংলাভাষায় কোন অভিধানের কথা কল্পনা করা যায় না। যতসম্ভব জানা যায় ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সর্বপ্রথম বাংলা শব্দ গঠন ও উচ্চারণের জন্য একটি বাংলা উচ্চারণ অভিধান প্রণয়ন করে। সম্ভবত এটিই বাংলাভাষার সর্বপ্রথম অভিধান। এ হতেই বাংলাভাষায় অভিধান প্রণয়নের ধারা সূচনা হয়।

গত ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে পূর্বপাকিস্তানে বাংলাভাষায় অভিধান প্রণয়নের সর্ব প্রথম প্রকল্প গৃহীত হয়। ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তা আংশিক প্রকাশ করা হয়। অতঃপর ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে পরিপূর্ণ বাংলা অভিধান বাংলাদেশে প্রকাশিত হয়। ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে অভিধানটির পুনঃসংস্করণ প্রকাশিত হয়। গত ১৪/১২/০২ খ্রিস্টাব্দে মোট ভুক্তি ৩২,৭৩৭ টি এবং ভুক্তি ও উপভুক্তিসহ মোট ৭৩,২৭৯টি শব্দের অভিধা নিয়ে বাংলা একাডেমি (বাংলাদেশ) কর্তৃক বর্তমান “ব্যবহারিক বাংলা অভিধান” টি প্রণীত হয়।

পর্যবেক্ষণ
ওপরোক্ত তথ্যাদির ভিত্তিতে বলতে পারি গত ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে যেসব গ্রন্থাদি বাংলাভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল, তা একান্ত অনুবাদকগণের চেষ্টা ও প্রয়াসপ্রসূত। কারণ কোন গ্রন্থের অনুবাদ বা ভাষান্তর করতে হোলে অবশ্যই ভাষান্তরকৃত ও ভাষান্তরিত উভয় ভাষার অভিধান একান্ত প্রয়োজন। তা না হোলে “রামায়ণ” ও “কুরান” এর মতো এহেন মহাগ্রন্থাদি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অর্জিতশব্দাদির দ্বারা অনুবাদ বা ভাষান্তর করা কারো পক্ষে কখনই সম্ভব নয়। কেউ যদি উভয় ভাষার অভিধান ব্যতীত মতগড়াভাবে কোন সাধারণ গ্রন্থেরও অনুবাদ করে থাকেন তবে তা সর্বসাধারণের গ্রহণযোগ্য নয়।

এবার (১৯৩৬-২০১০) খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রণীত ১.বাংলা-বাংলা, ২.বাংলা-ইংরেজি, ৩.বাংলা-আরবি, ৪.ইংরেজি-বাংলা, ৫.আরবি-বাংলা, ৬.ফার্সি-বাংলা, ৭.উর্দু-বাংলা, ৮.হিন্দি-বাংলা ও ৯.পালি-বাংলা অভিধানাদির মধ্যে রূপকশব্দাদি বা আধ্যাত্মিকদৈবিকাদির কোন শব্দেরই অভিধা যে প্রণয়ন করা হয়নি তা নিচে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

“আজ পাশাখেলবরে শ্যাম, ও শ্যামরে তোমার সনে
একেলা পেয়েছিরে শ্যাম, এ নিধুবনে।”
ধরি ওপরোক্ত চরণমালায় উদ্ধৃত “পাশাখেলা”, “শ্যাম” ও “নিধুবন” এ তিনটি শব্দের অভিধা আমাদের জানা প্রয়োজন বিধায় আমরা এখন বিভিন্ন অভিধান হতে উক্ত শব্দত্রয়ের অভিধা জানার চেষ্টা করব।

১. বাংলাদেশের ব্যবহারিক বাংলা অভিধান (ব্যাঞ্জনবর্ণ অংশ)
পাশাখেলা ক্রি নেই।

২. ব্যবহারিক বাংলা অভিধান (বাংলা একাডেমি)
পাশাখেলা ক্রি নেই।

৩. ব্যবহারিক শব্দকোষ (বাংলাভাষার অভিনব অভিধান)
পাশাখেলা ক্রি নেই।

৪. আধুনিক বাংলা বানান (অর্থ উচ্চারণ অভিধান)
পাশাখেলা ক্রি নেই।

ওপরোক্ত অভিধানাদির কোনটির মধ্যেই বাংলা ‘পাশাখেলা’ শব্দটি গ্রহণ করাই হয়নি তাহলে আমরা‘পাশাখেলা’ শব্দটির অভিধা জানব কিভাবে? প্রতিটি ভাষার গোড়া হলো অভিধান। সেই অভিধানেই যদি না থাকে তবে গোড়ায় ভুল। আর যার গোড়ায় ভুুল তার আগা-মাথায় কী থাকতে পারে তা অতি সহজেই অনুমান করা যায়। প্রমাণ করার জন্য নয় কেবল একান্ত প্রয়োজনেই আমরা এরূপ পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছি।

সমাধান
পাশাখেলা (রূপ)বি নর ও নারির মধুময় মিলন (আবি)বি সঙ্গম, সহবাস, কেলি, গমন, মিলন, মৈথুন, সম্ভোগ(অশি)বি চুদ, চুদন, চুদা, সেক্সুয়াল ইন্টারকর্স (sexual intercorce), ওয়াতিউ (.ﻭﻄﻰ), জিমাউ (.ﺠﻤﺎﻉ), লাওয়াতাত (.ﻟﻮﺍﻄﺔ) (আঞ্চ)ক্রি করা, লাগানো, গুয়ানো (আভা)বি অক্ষক্রীড়া, কাম, কেলি, গোষ্ঠখেলা, দ্যূতক্রীড়া, নিত্যকর্ম, বপ্রকেলি, বপ্রক্রীড়া, বাইচালি, জার্নি (jurney) (আপ্র)  সঙ্গম পরিবারের সদস্য ও রূপকসাহিত্যের একটি পরিভাষা বিশেষ (সংজ্ঞা) নর ও নারির মধুর মিলনকে সঙ্গম বা পাশাখেলা বলে(আপ)বি সালাত (.ﺻﻠﻮﺓ), বন্দেগি (ফা.ﺒﻧﺪﮔﻰ) (ইপ)বি র‌্যাপ (rape), কোপুলেশন (copulation) (উপ)বি  উপাসনা, পূজা, হোম, প্রেয়ার (prayer), ইবাদত (.ﻋﺑﺎﺪﺖ) (রূ)বি পাশাখেলা (দেত)বি কাম।

এবার নিচে “শ্যাম” শব্দটির কয়েকটি অভিধান অবিকল তুলে ধরা হলো।
১. বাংলাদেশের ব্যবহারিক বাংলা অভিধান (ব্যাঞ্জনবর্ণ অংশ)
শ্যাম বিণ  ১.মেঘবর্ণ, কালোবর্ণ, কৃষ্ণবর্ণ, ঘননীলবর্ণ ২.বিণ ফর্সা বা গৌরাঙ্গ এমন ৩.বিণ সবুজবর্ণ ৪.বিকৃষ্ণ।

২. ব্যবহারিক বাংলা অভিধান (বাংলা একাডেমি)
শ্যাম বিণ  ১.মেঘবর্ণ, কৃষ্ণবর্ণ, কালোবর্ণ, ঘন নীলবর্ণ  ২.ফর্সা ও গৌরাক্সগ এমন  ৩.সবুজবর্ণ (শ্যাম দূর্বাদল)৪.কৃষ্ণ।

৩.ব্যবহারিক শব্দকোষ (বাংলাভাষার অভিনব অভিধান)
শ্যাম বিণ কৃষ্ণবর্ণ, কৃষ্ণবর্ণবিশিষ্ট, সবুজ বি মেঘ, কোকিল, প্রয়াগস্থ বটবৃক্ষ বিশেষ, সামুদ্রিক লবণ, শ্রীকৃষ্ণ।

৪. আধুনিক বাংলা বানান-অর্থ-উচ্চারণ অভিধান
শ্যাম বি.বিণ মেঘবর্ণ, ঘন-নীলবর্ণ, কৃষ্ণবর্ণবিশিষ্ট।

বিভিন্ন অভিধান হতে প্রাপ্ত শব্দাদি
বিণ কালোবর্ণ, কালোরঙ, কৃষ্ণবর্ণ, কৃষ্ণবর্ণবিশিষ্ট, ঘন-নীলবর্ণ, মেঘবর্ণ, সবুজ, সবুজবর্ণ, ফর্সা বা গৌরাঙ্গ এমন বি কৃষ্ণ, শ্রীকৃষ্ণ, মেঘ, কোকিল, প্রয়াগস্থ বটবৃক্ষ বিশেষ, সামুদ্রিক লবণ।”

পর্যালোচনা (The discussion)
ওপরোক্ত শব্দাদির মধ্যে “কালোবর্ণ, কালোরঙ, কৃষ্ণবর্ণ, কৃষ্ণবর্ণবিশিষ্ট, ঘন-নীলবর্ণ ও মেঘবর্ণ” ইত্যাদি বাংলা ‘শ্যাম’ শব্দটির যথাশব্দ বা প্রকৃত অভিধা কিন্তু “সবুজ, সবুজবর্ণ ও ফর্সা বা গৌরাঙ্গ এমন” ইত্যাদি বাংলা “শ্যাম” শব্দটির যথাশব্দ কিম্বা অভিধা নয় বরং এ শব্দাদি বাংলা “শ্যাম” শব্দটির প্রকৃত অভিধা উদ্ঘাটনের জন্য ব্যবহৃত রূপকব্যাখ্যামূলক অভিধামাত্র। আবার “কৃষ্ণ, শ্রীকৃষ্ণ ও মেঘ” ইত্যাদি বাংলা ‘শ্যাম’ শব্দটির রূপকশব্দ বা দৈবিকা এবং “কোকিল, সামুদ্রিক লবণ ও প্রয়াগস্থ বটবৃক্ষ বিশেষ” ইত্যাদি বাংলা ‘শ্যাম’ শব্দটির ভিন্নভিন্ন অভিধা।

সমাধান
শ্যাম (রূপ)বি মেঘ, মেঘবর্ণ, কালোবর্ণ, কৃষ্ণবর্ণ (বাদৈ)বিণ ঈশ্বর, কাঁই, কাজলা, কালা, কালিয়া, কেলে, কৃষ্ণ, বিরিঞ্চি, ব্রহ্মা, শ্যামল, শ্যামলা (পরি) মানবদেহে প্রাপ্ত কালোবর্ণের জীবজল বা মধুবৎ মিষ্ট অমৃতসুধা, মানবদেহে আত্মা বা জীবনিশক্তি ধারণকারী বা বহনকারী কালো বর্ণের এক প্রকার রস। সাধু ও সন্ন্যাসিগণ এ শ্যামরস প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দর্শনলাভ করে কাঁইজি, ব্রাহ্মণ বা ব্রহ্মচারী উপাধিলাভ করে থাকেন (আবি)বিসৃষ্টিকর্তা, উৎপাদক, জনক, নির্মাতা, পিতা, ক্রিয়েটর (creator), অথার (autuor), খালেক্ব (.ﺨﺎﻟﻖ)(আভা)বি অগ্নি, অনাদি, অনন্ত, বিধাতা, বিবস্বান, স্বায়ম্ভু (আদৈ)বি আল্লাহ (.ﺍﻠﻠﻪ), ইসা (.ﻋﻴﺴﻰٰ), ইসামসিহ্ (.ﻋﻴﺲٰﻤﺴﻴﺢ), মসিহ (.ﻤﺴﻴﺢ), শাম (.ﺷﺄﻢ), শামস (.ﺸﻤﺲ), শিশ (.ﺸﻴﺶ) (ইদৈ)বি লর্ড (lord), মেকার (macker), প্রডিউসার (producer), ডিজাইনার (designier) (সংজ্ঞা) সৃষ্টিক্রিয়ার সরাসরি অংশগ্রহণকারী অনুঘটককে সৃষ্টিকর্তা বা শ্যাম বলে (আপ্র) সৃষ্টিকর্তা পরিবারের সদস্য ও রূপকসাহিত্যের একটি পরিভাষা বিশেষ (রূ)বি কাঁই (দেত)বি সৃষ্টিকর্তা।

অনুরূপভাবে নিচে “নিধুবন” শব্দটির কয়েকটি অভিধান অংশ অবিকল তুলে ধরা হলো।
১. বাংলাদেশের ব্যবহারিক বাংলা অভিধান (ব্যাঞ্জনবর্ণ অংশ)
নিধুবন১ (রূপ)বি মৈথুন, রমণ, শুক্রবিলাস, কামকেলি ২.বি আমোদ-প্রমোদ, ক্রীড়া-কৌতুক।
নিধুবন২ (রূপ)বি বিন্দাবনে অবস্থিত নিধু নামক বন, রাধাকৃষ্ণের কেলি-মালঞ্চ।

২. ব্যবহারিক বাংলা অভিধান (বাংলা একাডেমি)
নিধুবন (রূপ)বি বৃন্দাবনে অবস্থিত নিধু নামক বন, রাধা-কৃষ্ণের কেলি মালঞ্চ।

৩. ব্যবহারিক শব্দকোষ (বাংলাভাষার অভিনব অভিধান)
নিধুবন (রূপ)বি মৈথুন, শুক্রক্রিয়া, বৃন্দাবনের রাধাকৃষ্ণের লীলাস্থল বিশেষ।

৪. আধুনিক বাংলা বানান (অর্থ উচ্চারণ অভিধান)
নিধুবন (রূপ)বি নেই।

বিভিন্ন অভিধান হতে প্রাপ্ত শব্দাদি
বি মৈথুন, রমণ, শুক্রক্রিয়া, শুক্রবিলাস, কামকেলি, আমোদ-প্রমোদ, ক্রীড়া-কৌতুক, বিন্দাবনে অবস্থিত নিধুনামক বন, রাধাকৃষ্ণের কেলি-মালঞ্চ, বৃন্দাবনের রাধাকৃষ্ণের লীলাস্থল বিশেষ।”

পর্যালোচনা (The discussion)
ওপরোক্ত শব্দাদির মধ্যে “মৈথুন, রমণ, শুক্রক্রিয়া, শুক্রবিলাস, কামকেলি, আমোদ-প্রমোদ ও ক্রীড়া-কৌতুক” ইত্যাদি বাংলা ‘নিধুবন’ শব্দটির যথাশব্দ কিম্বা অভিধা নয়। আবার “বৃন্দাবনে অবস্থিত নিধুনামক বন, রাধাকৃষ্ণের কেলি-মালঞ্চ ও বৃন্দাবনের রাধাকৃষ্ণের লীলাস্থল বিশেষ” ইত্যাদি বাক্য বা বাংক্যাংশাদির মধ্যে একটিও বাংলা “নিধুবন” শব্দটির প্রকৃত অভিধা নয় বরং এসব হলো বাংলা ‘নিধুবন’ শব্দটির অভিধা উদ্ঘাটনের জন্য নির্মিত প্রপক বা রূপকব্যাখ্যা মাত্র।

সমাধান
নিধুবন (রূপ)বি নারিদেহ, রমণিদেহ, নারিচিহ্নধারী দেহ (প্র) বৃন্দাবনে অবস্থিত নিধু নামক বন, রাধাকৃষ্ণের কেলিমালঞ্চ (পরি) নারিদেহের রূপকদৈবিকা (আবি)বি নারিদেহ, ওম্যানবডি (woman body), ফিমেলবডি (female body), বাদনুজ্জাওঝা (.ﺒﺪﻦﺍﻟﺯﻮﺟﺔ) (আভা)বি নাগরদোলা, পাতাল, ভূমি (আপ)বি ইমরাত (.ﺍﻤﺮﺃﺓ), মারয়াত (.ﻤﺮﺀﺓ) (ইপ)বি ওম্যান (woman), ফিমেল (female) (আপ্র) নারিদেহ পরিবারের সদস্য ও রূপকসাহিত্যের একটি পরিভাষা বিশেষ (সংজ্ঞা) ভগচিহ্নধারী দেহকে নারিদেহ বা নিধুবন বলে (রূ)বিনিধুবন (দেত)বি নারিদেহ।

গত ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দ হতে বাংলাভাষায় অভিধানাদি প্রণয়নের শুভসূচনা হলেও অভিধানবেত্তাগণের অদূরদর্শিতা কিম্বা রূপকজ্ঞানের দৈন্যতা হেতু বাংলা ও সংস্কৃতভাষার রূপকশব্দাদি তাদের প্রণীত অভিধানাদি হতে ক্রমেক্রমেই বিলুপ্ত হতে থাকে। বর্তমানে কিছুকিছু রূপকশব্দ কোন কোন অভিধানে পাওয়া গেলেও তার অভিধা বা প্রকৃতসত্তাদি পাওয়া যায় না কোথাও। অনুরূপভাবে সংস্কৃত-বাংলা, ইংরেজি-বাংলা, আরবি-বাংলা, ফার্সি-বাংলা, উর্দু-বাংলা, হিন্দি-বাংলা ও পালি-বাংলা ইত্যাদি অভিধান প্রণয়নের সময়ে রূপকশব্দাবলিকে জলাঞ্জলি দেয়া হয়েছে চিরতরে। ফলে আমাদের বাংভারতীয় উপমহাদেশে আধ্যাত্মিকবিদ্যা চর্চা ও অনুশীলন বা গবেষণা ক্রমেক্রমে প্রায় দুর্লভ হয়ে পড়ে। পক্ষান্তরে গড়ে উঠে রূপকথার গুদামপচা গল্পকাহিনি ও লোমহর্ষক কিংবদন্তিময় উপন্যাস ও উপকথাদি।

আলোচনার উপসংহারে এসে এ কথা না বলে আর উপায় নেই যে, একশ্রেণির অভিধানবেত্তারা যেসব শব্দ বুঝেন না সেসব শব্দ অভিধানে সংযোজনও করেন না। আবার আরেক শ্রেণির অভিধানবেত্তারা আত্মতত্ত্বভিত্তিক অভিধাদিকে তাদের মনগড়াভাবে প্রণয়ন করে থাকেন। যেমন আরবি ক্বিয়ামত অর্থ- কেউ কেউ লিখেছেন ‘মহাধ্বংস’, আবার কিছুকিছু অভিধানবেত্তা আছেন তারা কোন্ কবি শব্দটিকে কী অর্থে ব্যবহার করেছেন তা তুলে ধরতে গিয়ে শব্দের মূল অভিধাই হারিয়ে ফেলেছেন। বিভিন্ন কারণেই আমাদের বাংভারতের অধিকাংশ অভিধানেই আধ্যাত্মিকশব্দ বা রূপকপরিভাষাদি নেই। একজন পাঠক কয়েক দিবস পর্যন্ত বিভিন্ন গ্রন্থগারে হন্নে হয়ে ঘুরেও ‘নিধুবন’ শব্দটির অভিধা অবগত হতে পারবেন না। এরূপ কারণেই আমাদের এসব আলোচনা। পরীক্ষার জন্য এরূপ আলোচনা নয় কেবল একান্ত প্রয়োজনেই এরূপ আলোচনার সম্মুখীন হয়েছি। অভিধানবেত্তারা আরো যত্নবান হলে আমরা এসব সমস্যার উত্তরণ করতে পারব বলে আমরা আশা করি।

(সংক্ষিপ্ত সংকলন)
তথ্যসুত্র- আধ্যাত্মিকবিদ্যা পরিচিতি- বলন কাঁইজি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন