বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৩

আত্মার প্রকারভেদ- ০১ (আত্মদর্শন, আত্মতত্ত্ব, আধ্যাত্মিকবিদ্যা, দিব্যজ্ঞান, দেহতত্ত্ব এবং বলন দর্শন নোট)

আত্মার প্রকারভেদ
আত্মা পাঁচ (৫) প্রকার- ১.ভূতাত্মা (পঞ্চভূত) ২.মানবাত্মা (মন), ৩.মহাত্মা (জ্ঞান) ৪.জীবাত্মা (সাঁই) ও পরমাত্মা (কাঁই)।

এছাড়াও নিম্নরূপেও আত্মার বিভাগ করতে দেখা যায়।
(ক) ১.ক্ষিতি ২.অপ ৩.তেজ ৪.মরুৎ ও ৫.ব্যোম (সংস্কৃত)।
(খ) ১.পরমাত্মা ২.ভূতাত্মা ৩.জীবাত্মা ৪.প্রেতাত্মা ও ৫.গোআত্মা (বাউল)।
(গ) ১.আগুন ২.জল ৩.মাটি ৪.বাতাস ও ৫.বিদ্যুৎ (আত্মতত্ত্ব)।
(ঘ) ১.পরমাত্মা ২.ভূতাত্মা ৩.জীবাত্মা ৪.আত্মারাম ও ৫.আত্মারামেশ্বর (পুরাণী)।
(ঙ) ১.রুহে জিসমানি (رُوحِ ﺟﺴﻤﺎﻨﻰ) ২.রুহে সুলত্বানি (رُوحِ ﺴﻟﻄﺎﻨﻰ) ৩.রুহুল আমিন (رُوحٌ ﺍﻟﻤﻴﻦ) ৪.রুহুল কুদুস (رُوحٌ ﺍﻟﻘﺪﺲ) ও ৫.রুহুল্লাহ (رُوحٌ ﺍﻠﻟﻪ) (কুরানী)।

আত্মার সমন্বয়সাধন
১.অপ ২.অলোক ৩.আগুন ৪.আত্মারাম ৫.আত্মারামেশ্বর ৬.ক্ষিতি ৭.গোয়াত্মা ৮.জল ৯.জীবাত্মা ১০.তেজ ১১.পরমাত্মা ১২.প্রেতাত্মা ১৩.বাতাস ১৪.ব্যোম ১৫.ভূতাত্মা ১৬.মরুৎ ১৭.মহাত্মা ১৮.মাটি ১৯.মানবাত্মা ২০.রুহুল আমিন (رُوحٌ  ﺍﻟﻤﻴﻦ) ২১.রুহুল কুদুস (رُوحٌ ﺍﻟﻘﺪﺲ) ২২.রুহুল্লাহ (رُوحٌ ﺍﻠﻟﻪ) ২৩.রুহে জিসমানি (رُوحِ ﺟﺴﻤﺎﻨﻰ) ও ২৪.রুহে সুলত্বানি (رُوحِ ﺴﻟﻄﺎﻨﻰ)। আত্মা সম্পর্কে প্রাপ্ত এসব পরিভাষাদির অভিধা বা অর্থ জেনে নেওয়ার পর আলোচনা করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে আমরা মনে করি বিধায় নিচে আত্মার পরিভাষাদির অভিধা তুলে ধরা হলো-
(ওপরোক্ত পরিভাষাগুলোর অবিধা জানতে মূল গ্রন্থ দেখুন)

১. ভূতাত্মা
(১.আগুন ২.জল ৩.মাটি ৪.বাতাস ও ৫.বিদ্যুৎ)

ভূতাত্মা (রূপ)বি ভূতবৎ আত্মা, ভূতরূপ আত্মা (আবি)বি রূপকসাহিত্যের- ১.আগুন ২.জল ৩.মাটি ৪.বাতাস ও ৫.বিদ্যুৎ- এ পঞ্চাত্মার সমষ্টি।
আদিপঞ্চভূতের সমষ্টিকে রূপকসাহিত্যে ভূতাত্মা বলা হয়। {বাং.ভূত+ বাং.আত্মা}আত্মা (রূপ)বি প্রাণ, জীবন, জীবাত্মা (দেপ্র) পুরাণিদের মতে-১.পরমাত্মা ২.ভূতাত্মা ৩.জীবাত্মা ৪.আত্মারাম ও ৫.আত্মারামেশ্বর, কুরানিদের সাম্প্রদায়িক রূপকসংস্কার মতে- ১.রুহে জিসমানি (رُوحِ ﺟﺴﻤﺎﻨﻰ) ২.রুহে সুলত্বানি (رُوحِ ﺴﻟﻄﺎﻨﻰ) ৩.রুহুল আমিন (رُوحٌ ﺍﻟﻤﻴﻦ) ৪.রুহুল কুদুস (رُوحٌ ﺍﻟﻘﺪﺲ) ও ৫.রুহুল্লাহ (رُوحٌ ﺍﻠﻟﻪ), দেহ তাত্ত্বিকগণের মতে- ভূতাত্মা (পঞ্চভূত) মানবাত্মা (মন) মহানাত্মা (জ্ঞান), জীবাত্মা (সাঁই) ও পরমাত্মা (কাঁই), কোন কোন আত্মতাত্ত্বিকের মতে- ১.পরমাত্মা ২.ভূতাত্মা ৩.জীবাত্মা ৪.গোয়াত্মা ও ৫.প্রেতাত্মা (আবি)বি ১.আগুন ২.জল ৩.মাটি ৪.বাতাস ও ৫.বিদ্যুৎ- এ পঞ্চাত্মা।

ভূতাত্মার সংজ্ঞা
১. আধ্যাত্মিকবিজ্ঞানে জীব সৃষ্টির আদিপঞ্চভূতকে একত্রে ভূতাত্মা বলে। যথা- ১.আগুন ২.জল ৩.মাটি ৪.বাতাস ও ৫.বিদ্যুৎ।
২. জীব ও জড় সৃষ্টির, আগুন জল মাটি বাতাস ও অলোক- এ আদিপঞ্চোপাদানকে একত্রে ভূতাত্মা বলে।
৩. আদিচতুর্ভূতের প্রত্যেককেই ভূতাত্মা বলে। আদিচতুর্ভূত যথা- ১.আগুন ২.জল ৩.মাটি ও ৪.বাতাস। 
৪. জীব সৃষ্টির আদিভূতাদিকে ভূতাত্মা বলে, যেমন-  ১.আগুন।

আদিভূতাত্মা চার প্রকার- ১.আগুন ২.জল ৩.মাটি ও ৪.বাতাস। এ চতুর্ভূতের সমন্বয়ে অপর একটি অলৌকিকশক্তির উৎপত্তি হয়। সংক্ষেপে তাকে আলোক বা অলোক বা আলেক বলা হয়। মহাবিজ্ঞান বা আধ্যাত্মিকবিদ্যায় এ আলৌকিকশক্তিকেই জীবাত্মা বা আলেক বলে।

পবিত্র লালন হতেও ভূতাত্মার সন্ধান পাওয়া যায়। ‘লালন’ হতে ভূতাত্মার যে সন্ধান পাওয়া যায় তা নিচে তুলে ধরা হলো।
“জীবাত্মা পরমাত্মা, ভূতাত্মা আত্মারাম, আত্মা-রামেশ্বর দিয়ে পঞ্চাত্মা, এ ধড় হয় তাদের আস্তানা” (পবিত্র লালন-৫৪৯/২)।
সাধনবলে কখনো কখনো কোন কোন ভূতাত্মা সদস্যের হ্রাস-বৃদ্ধি করা যায়। যেমন- শ্বাস-প্রশ্বাস অধিক পরিমাণে গ্রহণ-বর্জনের দ্বারা সাময়িকভাবে দেহের তাপমাত্রা ইচ্ছেমত বৃদ্ধি করা যায়। আবার শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি নিয়ন্ত্রণ করে ইচ্ছেমত দেহকে বায়ু শূন্যও করা যায়। অধিক পরিশ্রম দ্বারা সাময়িক দেহের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করা যায়। এছাড়াও বিভিন্ন প্রকার রোগ ব্যাধির সময় জীবদেহে আদিচতুর্ভূতের অনেক হ্রাস-বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায়।আদিচতুর্ভূত জীবদেহ গঠনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ করে। তার মধ্যে জল ও বাতাস প্রত্যক্ষভাবে এবং আগুন ও মাটি পরোক্ষভাবে কাজ করে। জীব সরাসরি জল পান করে এবং শ্বাসরূপে বাতাস গ্রহণ করে কিন্তু আগুন ও মাটি জীবকুল সরাসরি গ্রহণ করতে পারে না। আগুন ও মাটি প্রক্রিয়াকরণ বা শোধন না করলে তা জীবকুল গ্রহণও করতে পারে না এবং তা জীবদেহ গঠনে অংশগ্রহণও করতে পারে না। প্রাণিকুল ফুসফুস, বৃক্ষকুল পাতা এবং মৎস্যকুল কানের ফুলকার সাহায্যে বাতাস হতে অম্লজান গ্রহণ করে। এভাবেই জীবকুল পরোক্ষভাবে অম্লজান গ্রহণ করে। আবার উদ্ভিদকুল মাটি হতে মাটির সারাংশ গ্রহণ করে যে শস্যাদি ও ফলাদি উৎপন্ন করে জীবকুল তা খেয়ে জীবন ধারণ করে। এভাবেই জীবকুল পরোক্ষভাবে মাটি গ্রহণ করে। ভিন্নভিন্ন অধ্যায়ে আদিপঞ্চভূত বা ভূতাত্মার বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

ভূতাত্মার প্রকারভেদ
ভূতাত্মা ৫ প্রকার। যথা- ১.আগুন আত্মা ২.জল আত্মা ৩.মাটি আত্মা ৪.বাতাস আাত্মা ৫.বিদ্যুৎ আত্মা।

১. আগুন আত্মা
আগুনের সংজ্ঞা
 দাহ্যশক্তিকে আগুন বলে।

আগুনের আধ্যাত্মিকসংজ্ঞা
 কাম বাসনাকে চন্দ্রচেতনা বা রূপকার্থে আগুন বলে।

আগুন আত্মার পরিচয়
আগুন প্রকৃত আত্মা নয়। তবে আগুন হলো- রূপকসাহিত্যে বর্ণিত আত্মতাত্ত্বিগণের নির্মিত,১.আগুন ২.জল ৩.মাটি ৪.বাতাস ও ৫.বিদ্যুৎ- এ পঞ্চাত্মার মধ্যে একটি। এটি বিশ্ব সৃষ্টির আদিপঞ্চভূতের অন্যতম ভূত। আত্মা ব্যতীত যেরূপ জীবের অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না, তদ্রপ এ আদিপঞ্চভূত ব্যতীত জীব সৃষ্টি কোন মতেই সম্ভব নয় বিধায় এদেরকে আত্মা বলা যায়। সৃষ্টির এ আদিউপাদানটির অধিক প্রয়োজন বিধায় আত্মার সাথে তুলনা করে এটিকে আত্মারূপে কল্পনা করা হয়েছে। জীবাত্মার প্রকৃত স্বরূপ আবিষ্কার হওয়ার পূর্বে বিশ্বসৃষ্টির আদিভূত আগুনকে আত্মা বলা যথেষ্ট হয়েছে। আত্মা ব্যতীত যেমন জীব বাঁচতে পারে না তদ্রপ আগুন  নামক এ আদিভূতটির অবর্তমানে বিশ্বের কোন প্রাণিই বাঁচতে পারে না।

২. জল আত্মা
জলের সংজ্ঞা
 সর্ব জীবের প্রাণ রক্ষাকারী সুপেয় তরল পদার্থকে জল বলে।

জলের আধ্যাত্মিকসংজ্ঞা
মাতৃজঠরে সর্ব জীবের ভ্রণ লালনকারী অমৃতরসকে পালনকর্তা বা রূপকার্থে জল বলে।

জল আত্মার পরিচয়
জল পরিভাষাটি জীবের প্রকৃত আত্মা নয়। জীবকুলকে বাঁচিয়ের রাখার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে জলকে আত্মা বলা হয়। জল হচ্ছে ভূতাত্মার সদস্য- যা বিশ্ব সৃষ্টির আদিপঞ্চভূতের অন্যতম। জীবাত্মা ব্যতীত যেরূপ জীবের অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না তদ্রপ আদিভূত জল ব্যতীত জীব সৃষ্টিরও কল্পনা করা যায় না বিধায় আদিপঞ্চভূতের সদস্য জলকে আত্মা বলা হয়। সৃষ্টির এ আদিউপাদানটির অধিক প্রয়োজন বিধায় আত্মার সাথে তুলনা করে এটিকে আত্মারূপে কল্পনা করা হয়েছে। বিশ্ব সৃষ্টির আদিভূত জলকে আত্মা বলা যথেষ্ট হয়েছে। আত্মা ব্যতীত যেমন জীব বাঁচতে পারে না তদ্রপ জল নামক এ আদিভূতটির অবর্তমানে বিশ্বের কোন প্রাণিই বাঁচতে পারে না। জীবকুলের বেঁচে থাকার জন্য আদিপঞ্চভূতের প্রয়োজনীয়তার ওপর নির্ভর করেই আদিপঞ্চভূত ভুক্ত “জল” নামক ভূতকে আত্মা বলা হয়েছে। জীবাত্মার প্রকৃত স্বরূপ আবিষ্কার হওয়ার পূর্বে এ ভূতকে আত্মা বলা যথার্থ ও যুক্তি সঙ্গত হয়েছে। রূপকসাহিত্যে জল দ্বারা মানবজল সাঁইকে বুঝায় এবং সাঁইকে আত্মা বলে। সাঁই বা পালনকর্তারূপ এ শুভ্রজল ব্যতীত যেহেতু কোন দ্বিপস্থ জীব সৃষ্টি হয় না এবং হতেও পারে না বিধায় সাঁইরূপ জীবজলকে আত্মা বলা যথার্থ। ফুলের মধ্যে এ সুমিষ্ট জল না থাকলে ফল হয় না। মাতৃজীবের মধ্যে এ সুপেয় জল না থাকলে সন্তান সৃষ্টি হয় না। এ জলের প্রয়োজনীয়তার আধিক্যের ওপর নির্ভর করেই একে আত্মা বলা হয়েছে। জল ও মানবজল সাঁইকে আত্মা বলা যথার্থ ও যুক্তিসঙ্গত হয়েছে।

৩. মাটি আত্মা
মাটির সংজ্ঞা
ভূপৃষ্ঠকে মাটি বলে।

মাটির আধ্যাত্মিকসংজ্ঞা
জীবের স্থূল আকারকে দেহ বা রূপকার্থে মাটি বলে।

মাটি আত্মার পরিচয়
মাটি পরিভাষাটির দ্বারা রূপকসাহিত্যে মানবদেহ বুঝানো হয়। আদিপঞ্চভূতের মধ্যে মাটি দ্বারাই যে দেহ নির্মিত হয় এ কথার ওপর প্রায় শতভাগ সাধু মনীষিগণই একমত। মাটি ভিন্ন অন্য কিছু দ্বারা জীব কাঠামো গঠন করা সম্ভব নয়। জীব কাঠামো না থাকলে আগুন, জল, বাতাস ও অলোক এবং আত্মা, মন ও জ্ঞান কিছুই রাখা সম্ভব হবে না। প্রাণ সঞ্চারের জন্য অতিব প্রয়োজনীয় এসব উপাদান না রাখতে পারলে কোন কোষ জীবন্ত হতে পারবে না। জীবদেহ গঠনের জন্য মাটির কোন বিকল্প নেই বলে মাটিকে দেহবৎ আত্মা বলা হয়। জীবাত্মার প্রকৃত স্বরূপ আবিষ্কার হওয়ার পূর্বে মাটিকে আত্মা বলা যথার্থ ও যুক্তি সক্সগত হয়েছে।

৪. বাতাস আত্মা
বাতাসের সংজ্ঞা
সর্ব জীবের প্রাণ রক্ষাকারী বায়বীয় (অম্লজান) পদার্থকে বাতাস বলে।

বাতাসের আধ্যাত্মিকসংজ্ঞা
নাসিকাযোগে চলাচলকারী শ্বাসকে বাতাস বলে।

বাতাস আত্মার পরিচয়
জীবকুল যেহেতু বাতাসের অম্লজান ছাড়া বাঁচতে পারে না। সেজন্য বাতাসকে রূপকসাহিত্যে আত্মা বলা হয়। শ্বাস গ্রহণের মাধ্যমে প্রাণিকুল নাসিকা দ্বারা ও মৎস্যকুল কানের ফুলকা দ্বারা বাতাস হতে অম্লজান গ্রহণ ও অঙ্গারাম্লজান বর্জন করে। আবার উদ্ভিদকুল পাতা বা ছাল দ্বারা বাতাস হতে অঙ্গারাম্লজান গ্রহণ ও অম্লজান বর্জন করে বলে রূপকসাহিত্যে শ্বাসরূপ বাতাসকে আত্মা বলা হয়। উল্লেখ্য বৈষয়িকসাহিত্যে বাতাস দ্বারা বায়ু বুঝায় কিন্তু রূপকসাহিত্যে বাতাস দ্বারা শ্বাস বুঝায়। অম্লজান ব্যতীত জীবকুল বাঁচতে পারে না বলে জীবাত্মার প্রকৃত স্বরূপ আবিষ্কার হওয়ার পূর্বে বাতাসের অম্লজানকে অর্থাৎ বাতাসকে আত্মা বলা যথার্থ হয়েছে। কিন্তু এখন আর বাতাসকে আত্মা বলা হয় না বরং বাতাসের অম্লজান ও অঙ্গারাম্লজান কেউ কেউ জীবের জীবাত্মা বলে থাকেন। আমরা এরূপ ধারণাকারিদের প্রতিবাদে বলব যে- বাতাস বা বাতাসের অম্লজান ও অঙ্গারাম্লজান কোনটিই প্রকৃত জীবাত্মা নয়। এ পদার্থদ্বয় জীবাত্মারূপ বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপাদান মাত্র। বিদ্যুৎ সৃষ্টির উপাদানকে বিদ্যুৎ বলা যায় না। তদ্রপ জীবাত্মা সৃষ্টির উপাদানকেও জীবাত্মা বলা যায় না। কিন্তু পূর্বকালে মনীষিদের ধারণা ছিল বাতাসই জীবদেহের জীবাত্মা। তাই তারা বাতাসকে জীবাত্মা ধরে অনেক ঐশিবাণী নির্মাণ করেছিলেন।

বিভিন্ন মহাগ্রন্থে বাতাসকে জীবাত্মা ধরে নির্মিত ঐশিবাণিগুলো নিচে তুলে ধরা হলো- পবিত্র কুরান হতে বাতাস আত্মার উদাহরণ
১. “فَإِذَا سَوَّيْتُهُ وَنَفَخْتُ فِيهِ مِنْ رُوحِي فَقَعُوا لَهُ سَاجِدِينَ” “অতঃপর যখন আমি তাকে সুঠাম করব এবং তার মধ্যে আত্মা ফুৎকার করব তখন তোমরা তাকে ভক্তি করবে” (কুরান, হিজর- ২৯)।
২. “فَإِذَا سَوَّيْتُهُ وَنَفَخْتُ فِيهِ مِنْ رُوحِي فَقَعُوا لَهُ سَاجِدِينَ” “অতঃপর যখন আমরা তাকে সুঠাম করব এবং তার মধ্যে আত্মা ফুৎকার করব, তখন তোমরা তাকে ভক্তি করবে” (কুরান, সোয়াদ- ৭২)
৩. “ثُمَّ سَوَّاهُ وَنَفَخَ فِيهِ مِنْ رُوحِهِ وَجَعَلَ لَكُمْ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَالْأَفْئِدَةَ قَلِيلًا مَا تَشْكُرُونَ” “অতঃপর তিনি তাকে সুঠাম করেছেন, তন্মধ্যে স্বীয় আত্মা ফুঁকে দিয়েছেন তাঁর নিকট হতে। তোমাদের দিয়েছেন কর্ণ, চক্ষু ও অন্তঃকরণ, তোমরা অতি সামান্যই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো” (কুরান, সিজদা- ৯)
৪. “وَمَرْيَمَ ابْنَتَ عِمْرَانَ الَّتِي أَحْصَنَتْ فَرْجَهَا فَنَفَخْنَا فِيهِ مِنْ رُوحِنَا وَصَدَّقَتْ بِكَلِمَاتِ رَبِّهَا وَكُتُبِهِ وَكَانَتْ مِنْ الْقَانِتِينَ” “হর্ম্যরে কন্যা অষ্ঠি যে স্বীয় জননেন্দ্রিয়কে সংরক্ষণ করেছিল অতঃপর আমরা তন্মধ্যে স্বীয় আত্মা ফুৎকার করেছিলাম। সে আপন প্রতিপালকের বাক্যাদি ও তাঁর গ্রন্থাদিকে সত্যতার সাথে গ্রহণ করেছিল এবং সে অনুগতাদের একজন ছিল” (কুরান, তাহরিম- ১২)

পবিত্র লালন হতে বাতাস আত্মার উদাহরণ
১. “আত্মারূপেতে কেবা, দেহভাণ্ডে করে সেবা, দেখ দেখ যেবা, হও মহাশয়” (পবিত্র লালন- ১০৫/২)
২. দেহের জরিব হয় নাইরে, মন তোর ভুল পড়েছে, ধড় ছেড়ে আত্মা গেলে মানুষ কী বাঁচে” (পবিত্র লালন- ৫৫১/১)
৩. মনেরমানুষ সত্য জেনে, বলো এখন যাও কোথায়, হাওয়ারূপে এ দেহে, আত্মা আসে আত্মা যায়” (পবিত্র লালন- ৭৬০/১)।
ওপরোক্ত উদ্ধৃতিগুলো হতে পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় যে- পদার্থ বিজ্ঞানিদের দ্বারা বাতাস বিভাজনের পূর্বে সাধু, গুরু ও গোঁসাই সবাই বাতাসকে আত্মা বলতেন। অতঃপর বিজ্ঞানিদের দ্বারা বাতাস বিভাজন হওয়ার পর দেখা যায় বাতাসের মধ্যে মোট ২৩টি পদার্থ বিদ্যমান। তার মধ্যে একটি পদার্থ হলো- অম্লজান (অক্সিজেন. oxygen)। এ পদার্থটি জীবদেহের বিদ্যুৎরূপ জীবাত্মা উৎপাদনে সাহার্য করে থাকে এবং অন্য একটি পদার্থ হলো- অঙ্গারাম্লজান (কার্বন ডাইয়ক্সাইড. carbon dioxide)। এ পদার্থটি উদ্ভিদের বিদ্যুৎরূপ জীবাত্মা উৎপাদনে সাহায্য করে থাকে। বাতাসের এ দু’টি পদার্থ ব্যতীত জীবকুল ও উদ্ভিদকুল এক মুহূর্তকালও বাঁচতে পারে না। এজন্যই পূর্বকালে বাতাসকে জীবের জীবাত্মা বলা হতো। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ পদার্থদ্বয় জীব বা উদ্ভিদ কোন আত্মা নয়। তবে পদার্থদ্বয় জীব ও উদ্ভিদের বিদ্যুৎরূপ জীবাত্মা উৎপাদনের উপাদান মাত্র।

৫. অলোক আত্মা
অলোকের সংজ্ঞা
 অলৌকিক বিষয়াবলিকে সংক্ষেপে অলোক বলে।

অলোকের আধ্যাত্মিকসংজ্ঞা
 জীবকোষ সৃষ্টি ও জীবিত রাখার দায়িত্ব পালনকারী শক্তিকে অলোক বলে।

অলোক আত্মার পরিচয়
অলোক পরিভাষাটির আভিধানিক অর্থ- “১.অলৌকিক, লোকাতীত, সাধ্যাতীত, মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় এরূপ, ইহলোকের নয় এরূপ ২.নির্জন, বিজন, অসাধারণ, লোক বসতিহীন (ব্য্য) অলৌকিক পরিভাষাটির সংক্ষিপ্ত রূপ।” যে সত্তা ব্যতীত জীবকুল বেঁচে থাকতে পারে না এবং যার কোন আকার প্রকার নেই এরূপ সত্তাকে অলোক বলা হয়। এটিই হলো জীবের প্রকৃত আত্মা। অর্থাৎ জীবাত্মার অপরনাম অলোক বা আলোক।  আদিপঞ্চভূত পরিচিতিপঞ্চভূতের একীভূত সমষ্টিই জীবের চৈতন্য। চৈতন্যতাই কাঁইসত্তা। পঞ্চভূত বিভূতি হতেই এ ক্ষুদ্র ও বৃহৎ পরিদৃশ্যমান জগৎ গঠিত হয়েছে। পঞ্চভূতের মধ্যে অলোকের একটি মাত্র গুণ। এ শক্তিটি কারো আশ্রয়ীভূত নয়। অলোক সৃষ্টি না হলে বিশ্বের কোন জীবই সৃষ্টি হতো না। অবশিষ্ট চারটি ভূতের অপার লীলার জন্যই অলোকশক্তির বিশেষ প্রয়োজন। এ অলোকের অভাবে সব সৃষ্টি অচল হয়ে পড়ত বিধায় সারাসৃষ্টিজগতের ওপর অলোকের শ্রেষ্ঠত্ব সর্বাধিক।

পঞ্চভূত তত্ত্ব বর্ণনা

“পঞ্চভূতে গঠিত হয় ত্রিসংসার
পঞ্চভূত বিনে কোন বস্তু নাই আর।
পঞ্চভূত তত্ত্বসহ বটে একরূপ
জীবাত্মা পরমাত্মা মিলে স্বরূপ।
পদার্থ শব্দের অর্থ করি যে বর্ণন
পঞ্চভূত নাম হয় পদার্থ গণন।
তত্ত্ব শব্দে পঞ্চতত্ত্ব পঞ্চভূতময়
শব্দ স্পর্শ রূপ রস গন্ধ হয়।
তত্ত্ব শব্দের অর্থ কহি শুনহ বিস্তার 
চতুর্বিংশ পঞ্চবিংশ মোহতত্ত্ব আর। 
ইহাকে জানিলে জীব জনমমুক্ত হয় 
অনিত্য দেহ নিত্য হয় জানিও নিশ্চয়। 
গুরু-শিষ্য এক আত্মা হইবে যখন 
নিত্য নিধুবনে যাবে করিবে সাধন। 
এ পঞ্চতত্ত্ব যে অবগত হয় 
সে জনমমুক্ত জানিয় নিশ্চয়।"

১.আগুন ২.জল ৩.মাটি ৪.বাতাস ও ৫.বিদ্যুৎকে একত্রে পঞ্চভূত বলা হয়। এ পঞ্চভূতের কোন ভূতের কী গুণ তা নিচে তুলে ধরা হলো।

১. আগুনের পঞ্চগুণ
যথা- ১.কাম ২.ক্ষুধা ৩.তৃষ্ণা ৪.নিদ্রা ও ৫.ভ্রান্তি।

২. জলের পঞ্চগুণ
যথা- ১.শুক্র ২.শোণিত ৩.জল ৪.মল ও ৫.মজ্জা।

৩. মাটির পঞ্চগুণ
যথা- ১.অস্থি ২.মাংস ৩.নখ ৪.ত্বক ও ৫.লোম।

৪. বাতাসের পঞ্চগুণ
যথা- ১.আলস্য ২.ক্রোধ ৩.লোভ ৪.মোহ ও ৫.লজ্জা। 

৫. অলোকের পঞ্চগুণ
যথা- ১.জীবন্ত ২.ঘুমন্ত ৩.অজ্ঞান ৪.মৃত ও ৫.নিত্য।

১. আগুন বশীভূত করতে হয় চর্চা ও গবেষণা দ্বারা,
২. জল বশীভূত করতে হয় নামকীর্তন দ্বারা,
৩. মাটি বশীভূত করতে হয় পারম্পরিক মানুষ গুরুর কৃপাবলে,
৪. বাতাস বশীভূত করতে হয় অভিনিবেশ বা ধ্যান দ্বারা,
৫. বিদ্যুৎ বশীভূত করার কোন পদ্ধতি এখনো আবিষ্কার হয়নি।

অলোক বশীভূত করার অর্থ আত্মার ওপর পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। আর আত্মা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে মানুষ মহাবিশ্বের জ্যোতিষ্কদের মতো চিরস্থায়ী হতে পারবে।

(সংক্ষিপ্ত সংকলন)
তথ্যসূত্র- আত্মার সৃষ্টি রহস্য (আত্মমুক্তির পথ)- বলন কাঁইজি

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন